প্রতি বছর বর্ষা আসে, আর তার সাথে নিয়ে আসে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া পাড়ের মানুষের জন্য সীমাহীন দুর্ভোগ। বাঁধ ভেঙে যাওয়া, ঘরবাড়ি প্লাবিত হওয়া আর ফসলের জমি ডুবে যাওয়া—এ যেন এক বাৎসরিক নিয়তি। কিন্তু এই নিয়তি বদলের জন্য এবার সরকার এক নতুন ও শক্তিশালী পদক্ষেপের কথা ভাবছে, যা একই সাথে আশা এবং গভীর আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেনাবাহিনীর বাঁধ পরিকল্পনা
সম্প্রতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ফেনীর বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে জানিয়েছেন, বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সরকার সেনাবাহিনী দিয়ে বাঁধ নির্মাণের চিন্তা করছে।
এই একটি ঘোষণাই অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সেনাবাহিনীর মতো একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীকে দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হলে তা কি সত্যিই টেকসই হবে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই উদ্যোগ পরিবেশ এবং চলমান জলবায়ু পরিবর্তন সংকটের প্রেক্ষাপটে কতটা যুক্তিযুক্ত? চলুন, এই বিষয়গুলো একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যাক। সেনাবাহিনীর বাঁধ পরিকল্পনা
কেন বাঁধ নির্মাণে সেনাবাহিনী? আস্থার সংকট না দক্ষতার খোঁজ?
প্রথমেই যে প্রশ্নটি মাথায় আসে তা হলো, পানি উন্নয়ন বোর্ড বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা থাকতে কেন সেনাবাহিনীকে প্রয়োজন হচ্ছে? এর উত্তর शायद লুকিয়ে আছে কাজের মান এবং দীর্ঘসূত্রিতার প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থার মধ্যে। উপদেষ্টার ভাষ্যমতে, “ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কাজ যাতে ভালো মানের হয়… কারিগরি দক্ষতা থেকে শুরু করে সব কিছু যাতে ভালো হয়, সে জন্য আমরা সেনাবাহিনীর কথা ভাবছি।”
এই কথাটি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, অতীতের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। প্রতি বছর বাঁধ সংস্কারে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও তা এক বর্ষার ধাক্কাও সামলাতে পারে না। দুর্নীতি, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার এবং সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া—এই অভিযোগগুলো বহু পুরনো। এক্ষেত্রে, সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা, কর্মদক্ষতা এবং দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকার খ্যাতিই হয়তো সরকারকে এই পথে ভাবতে উৎসাহিত করেছে। আপাতদৃষ্টিতে, এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যা ফেনীর মানুষের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করতে পারে। সেনাবাহিনীর বাঁধ পরিকল্পনা
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের চোখে এই বাঁধ কতটা টেকসই?
এবার আসা যাক আমাদের মূল আলোচনায়। আমাদের প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন। একটি শক্তিশালী ও মজবুত বাঁধ तात्ক্ষণিকভাবে বন্যা থেকে মুক্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদে তা পরিবেশের জন্য কতটা উপকারী?
জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোনো বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ তত্ত্ব নয়, এটি একটি কঠোর বাস্তবতা। এর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ধরনে বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন অতি অল্প সময়ে অস্বাভাবিক পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে, যা নদীর পানি বহনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে, উজানের পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে, শুধু উঁচু আর কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ কি একমাত্র সমাধান?
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের কিছু মারাত্মক পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে:
- নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা: শক্ত বাঁধ নদীর স্বাভাবিক স্রোতকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে নদীর ভাটিতে পলি জমার হার কমে যায়, যা জমির উর্বরতা নষ্ট করতে পারে। অন্যদিকে, বাঁধের উজানে অতিরিক্ত পলি জমে নদী আরও ভরাট হয়ে যেতে পারে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকি তৈরি করবে।
- জীববৈচিত্র্যের উপর বিরূপ প্রভাব: নদী একটি জীবন্ত ইকোসিস্টেম। বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর চলাচল ও প্রজননক্ষেত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে স্থানীয় মৎস্য সম্পদ এবং নদীর উপর নির্ভরশীল জীববৈচিত্র্য সংকটে পড়তে পারে।
- নতুন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি: অনেক সময় বাঁধগুলো পানি নিষ্কাশনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরিবর্তে বিস্তীর্ণ এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, যা ফসলের জন্য বন্যার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।
তাহলে সমাধান কী? উপদেষ্টার কথা অনুযায়ী, সরকার একটি “টেকসই বেড়িবাঁধ” নির্মাণ করতে চায়। এখানে ‘টেকসই’ শব্দটির গুরুত্ব অপরিসীম। টেকসই বাঁধ মানে শুধু মজবুত কাঠামো নয়, বরং এমন একটি ব্যবস্থা যা পরিবেশ-এর সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করবে। এর জন্য প্রয়োজন একটি সামগ্রিক নদী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, যেখানে বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি নিয়মিত নদী খনন, নদীর দুই তীরে বনায়ন এবং পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতিপথকে সম্মান জানানোর মতো বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
ত্রাণ বনাম টেকসই সমাধান: একটি চিরন্তন বাস্তবতা
উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ফেনীর মানুষের একাংশ বলছেন, ‘ত্রাণ লাগবে না, শুধু টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।’ অন্যদিকে, উপদেষ্টা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘অতি দরিদ্র মানুষরা এখন অসহায়, তাদের ঘরবাড়ি ও খাবার নেই, তাদের আগে বাঁচাতে হবে।’
এটি একটি ক্লাসিক পলিসি ডিলেমা। দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নিঃসন্দেহে সবচেয়ে জরুরি, কিন্তু যে মানুষটি আজ আশ্রয়হীন, তার কাছে ভবিষ্যতের টেকসই বাঁধের চেয়ে তাৎক্ষণিক ত্রাণ অনেক বেশি প্রয়োজন। সরকারকে এই দুইয়ের মধ্যে একটি কঠিন সমন্বয় করতে হয়। তবে আশার কথা হলো, সরকার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের গুরুত্ব উপলব্ধি করছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে সেনাবাহিনীকে দিয়ে বাঁধ নির্মাণের চিন্তার মধ্যে।
শেষ কথা: সমাধান কোন পথে?
বন্যা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করার চিন্তা নিঃসন্দেহে একটি সাহসী এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এটি প্রচলিত ব্যবস্থার দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার একটি আন্তরিক প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখা যেতে পারে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হয়তো একটি মজবুত বাঁধ তৈরি হবে, যা ফেনীর মানুষকে সাময়িকভাবে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করবে।
তবে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে আরও গভীরে। এই সমাধান যেন শুধু একটি বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা না হয়। জলবায়ু পরিবর্তন-এর মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে আমাদের চিন্তাভাবনায় একটি মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি। শুধু কংক্রিটের কাঠামোর উপর নির্ভর না করে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের (Nature-based Solutions) দিকেও আমাদের এগোতে হবে।
সেনাবাহিনী দক্ষতার সাথে বাঁধ নির্মাণ করতে পারে, কিন্তু আমাদের পরিবেশ ও নদীকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে হবে নীতি-নির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাইকেই। এই উদ্যোগ সফল হোক, তবে তা যেন হয় প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে বন্ধুত্ব করে, শত্রুতা করে নয়।
আপনার মতামত কী?
আপনি কি মনে করেন সেনাবাহিনী দিয়ে বাঁধ নির্মাণ বন্যা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান হতে পারে? নাকি এর পরিবেশগত ঝুঁকিগুলো নিয়ে আমাদের আরও গভীরভাবে ভাবা উচিত? আপনার মূল্যবান মতামত নিচের কমেন্ট বক্সে জানান।
পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত এমন আরও বিশ্লেষণমূলক লেখা পড়তে আমাদের সাথেই থাকুন!