26.5 C
Bangladesh
বৃহস্পতিবার, জুলাই ১৭, ২০২৫
spot_img

চরিত্র বদলে ভয়ঙ্কর ডেঙ্গু: ঢাকার বাইরে ছড়াচ্ছে বেশি?

একসময় আমরা ভাবতাম, ডেঙ্গু মানেই বর্ষাকাল আর রাজধানী ঢাকা। মশার কয়েল, স্প্রে আর মশারি টাঙানোর তোড়জোড়টা মূলত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেই দেখা যেত। কিন্তু সেই দিন কি এখন অতীত? এবারের পরিসংখ্যান কিন্তু সে কথাই বলছে। ডেঙ্গু এখন আর কোনো নির্দিষ্ট মৌসুম বা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে এক আতঙ্কের নাম হয়ে, যার পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে আমাদেরই তৈরি করা বড় সংকট: পরিবেশ বিপর্যয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন। চরিত্র বদলে ভয়ঙ্কর ডেঙ্গু

চলুন, একটু তলিয়ে দেখা যাক, কেন এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং আরও বেশি উদ্বেগজনক।

বদলে গেছে ডেঙ্গুর মানচিত্র: ঢাকা এখন আর কেন্দ্র নয়

এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় চমক হলো এর ভৌগোলিক বিস্তার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬০টি জেলাতেই এখন ডেঙ্গুর অস্তিত্ব। আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, মোট আক্রান্তের প্রায় ৭৮ শতাংশই ঢাকার বাইরের বাসিন্দা। ভাবুন একবার, যে রোগকে আমরা ‘ঢাকার অসুখ’ বলে জানতাম, সেটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামগঞ্জে, মফস্বল শহরে। গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, জয়পুরহাট ও সুনামগঞ্জ—এই চারটি জেলা বাদে সারাদেশই এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে। চরিত্র বদলে ভয়ঙ্কর ডেঙ্গু

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ যখন শুরু হয়, তখন এটি যেন ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে বিষয়ে যথেষ্ট কার্যকরী পদক্ষেপের অভাব ছিল। এর ফলে ঢাকার বাইরের বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা এই রোগ মোকাবিলার জন্য মানসিকভাবে বা অবকাঠামোগতভাবে প্রস্তুত নয়, তারা এখন মারাত্মক বিপদে পড়েছে।

পরিসংখ্যান দেখলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। এই জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্ত ১৪ হাজার ৪৬০ জন, যার মধ্যে মাত্র ৩ হাজার ১৩৮ জন ঢাকা মহানগরীর। বাকি ১১ হাজার ৩২২ জনই ঢাকার বাইরের! গত বছর এই সময়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ হাজার ৩৩৬, যার মধ্যে ঢাকার বাইরের রোগী ছিল ২ হাজার ৭৫২ জন। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে ঢাকার বাইরে সংক্রমণ বেড়েছে প্রায় চারগুণ!

মৃত্যুর মিছিলেও ঢাকার বাইরে বাড়ছে শঙ্কা

শুধু সংক্রমণ নয়, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হারেও এক বড় পরিবর্তন এসেছে। গত বছর এই সময়ে মোট মৃত্যুর ৭২ শতাংশই ছিল ঢাকায়। আর এ বছর? মোট ৫৫টি মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে ঘটেছে ২৬টি, যা মোট মৃত্যুর ৪৭ শতাংশ। প্রায় অর্ধেক! চরিত্র বদলে ভয়ঙ্কর ডেঙ্গু

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সামনের দিনগুলোতে ঢাকার বাইরে সংক্রমণের সাথে পাল্লা দিয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে পারে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ঢাকার হাসপাতাল ও চিকিৎসকেরা ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ হলেও, ঢাকার বাইরের অনেকেরই সেই অভিজ্ঞতা বা পরিকাঠামো নেই। যখন হঠাৎ করে রোগীর চাপ বাড়ে, তখন শক সিনড্রোমের মতো জটিল পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে, যা হওয়ার তাই হচ্ছে—বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি এবং পরিস্থিতি জটিলতর হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

তাহলে হঠাৎ এমন বদল কেন? উত্তর কি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে?

এখন আসল প্রশ্নে আসা যাক। কেন ডেঙ্গুর এই চরিত্র বদল? কেন অসময়ে, সারাদেশে এর এমন বিস্তার? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের নজর দিতে হবে পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এর দিকে।

১. বদলে যাওয়া আবহাওয়া:জলবায়ু পরিবর্তন-এর প্রভাবে এখন আর ষড়ঋতুর হিসাব মেলানো যায় না। দীর্ঘস্থায়ী গরম, অসময়ে বৃষ্টি এবং হঠাৎ ভারী বর্ষণ—এই সবই এডিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে। আগে যেখানে শুধু বর্ষাকালে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ত, এখন বছরজুড়েই থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে যেখানে-সেখানে পানি জমছে। পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলের টব, ডাবের খোসা, নির্মাণাধীন ভবন—এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রের অভাব নেই। উষ্ণ আবহাওয়া মশার জীবনচক্রকেও দ্রুততর করে, ফলে এদের সংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে।

২. অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পরিবেশ দূষণ: ঢাকা একসময় কেন্দ্র ছিল, কিন্তু এখন উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে জেলা শহরগুলোতেও। তবে এই উন্নয়ন হচ্ছে অনেকটাই অপরিকল্পিতভাবে। যেখানে-সেখানে গড়ে উঠছে দালানকোঠা, কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা রয়ে গেছে সেই পুরোনো তিমিরেই। প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, আবর্জনার স্তূপ—এই সবই এডিস মশার আঁতুড়ঘর। আমাদের পরিবেশ নিয়ে এই অসচেতনতাই ডেঙ্গুকে সারাদেশের সমস্যা বানিয়ে তুলেছে।

৩. সচেতনতার অভাব: ঢাকার মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে যতটা সচেতন, মফস্বলের মানুষ ততটা নয়। কোথায় পানি জমতে দেওয়া যাবে না, কখন সতর্ক থাকতে হবে—এই বার্তাগুলো এখনো সঠিকভাবে সারাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। ফলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না।

শেষ কথা: লড়াইটা শুধু মশার বিরুদ্ধে নয়

পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে শুধু ফগার মেশিন চালিয়ে বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিমানা করে ডেঙ্গু নির্মূল করা সম্ভব নয়। এটি এখন আর শুধুমাত্র একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয়, বরং একটি গভীর পরিবেশ-গত এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সংকট।

এডিস মশা হলো সেই দূত, যে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার খবর পৌঁছে দিচ্ছে। আমরা যদি এখনই বৃক্ষনিধন বন্ধ না করি, কার্বন নিঃসরণ না কমাই এবং পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের পরিবেশ রক্ষা না করি, তাহলে ডেঙ্গুর মতো আরও অনেক রোগের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। লড়াইটা এখন শুধু মশার বিরুদ্ধে নয়, লড়াইটা আমাদের নিজেদের তৈরি করা সংকটের বিরুদ্ধে।

আপনার করণীয় কী?

এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এর প্রভাব মোকাবিলায় আপনার বা আপনার প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কী হতে পারে? আপনি কি জানেন, আপনার একটি ছোট পদক্ষেপও এই বড় লড়াইয়ে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে?

এই বিষয়ে আরও জানতে, আলোচনা করতে বা আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৌশল খুঁজে পেতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আসুন, একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একযোগে কাজ করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ