26.5 C
Bangladesh
বৃহস্পতিবার, জুলাই ১৭, ২০২৫
spot_img

প্রভাবশালীদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হলো ফ্ল্যাট!

ভাবুন তো, নদীর ভাঙনে বা সমুদ্রের করাল গ্রাসে আপনার ঘরবাড়ি, জমিজমা সব হারিয়ে গেল। আপনি সব হারিয়ে নিঃস্ব, একজন জলবায়ু উদ্বাস্তু। ঠিক সেই মুহূর্তে সরকার আপনার জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করল—একটি আধুনিক ফ্ল্যাট। আপনার মনে নতুন করে বাঁচার আশা জাগল। কিন্তু ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিতে গিয়ে আপনি জানলেন, আপনার নামটি তালিকায় নেই। আপনার পরিবর্তে সেই ফ্ল্যাট পেয়েছে এলাকার কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার হয়তো আরও দশটি বাড়ি আছে। কেড়ে নেওয়া হলো ফ্ল্যাট

কী অসাধারণ এক পরিহাস! ঠিক এই মর্মান্তিক ঘটনাই ঘটেছে কক্সবাজারের খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে। এটি শুধু একটি প্রশাসনিক ত্রুটি বা দুর্নীতির গল্প নয়, এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সংকট কতটা গভীরে এবং এর মানবিক মূল্য কতখানি। তবে সরকার এই বিতর্কিত বরাদ্দ বাতিল করায় সেই ভুক্তভোগী মানুষগুলোর মনে আবারও আশার আলো জ্বলে উঠেছে। কেড়ে নেওয়া হলো ফ্ল্যাট

প্রকল্পের স্বপ্ন: এক টুকরো নিরাপদ ভূমি

কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর তীরে ২৫৩ একর জমির উপর গড়ে তোলা হয়েছে দেশের প্রথম এবং বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প—’খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’। পাঁচতলা বিশিষ্ট ১৩৭টি ভবনে ৪,৪০৯টি পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার এই বিশাল উদ্যোগটি ছিল একটি যুগান্তকারী স্বপ্ন। যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তাদের জন্য এটি ছিল একটি স্থায়ী ঠিকানা, একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ।

২০২০ সালে প্রাথমিকভাবে ৬০০ পরিবারকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে এই স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়। সারা বিশ্বে যখন জলবায়ু সংকট নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন বাংলাদেশের এই প্রকল্পটি একটি ইতিবাচক উদাহরণ হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছিল। কিন্তু সেই প্রশংসার আড়ালেই চলছিল এক ভয়ঙ্কর অবিচার। কেড়ে নেওয়া হলো ফ্ল্যাট

স্বপ্নের সমাধি: যখন আশ্রয় কেড়ে নেয় প্রভাবশালীরা

সম্প্রতি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে যে, এই প্রকল্পে প্রকৃত জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অধিকাংশেরই জায়গা হয়নি। বরং, ২০১১ সালে তৈরি করা ৪,৪০৯ জনের সেই তালিকায় ঢুকে পড়েছিল বহু রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাদের আত্মীয়স্বজন। তালিকাটি ছিল “ত্রুটিপূর্ণ, প্রশ্নবিদ্ধ ও পক্ষপাতদুষ্ট”—স্বয়ং সরকারি প্রজ্ঞাপনেই এই কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।

সহজ কথায়, যাদের ঘর ভেসে গেছে, তারা রাস্তায়ই রয়ে গেল, আর যাদের ঘর আগে থেকেই ছিল, তারা পেল আরও একটি নতুন ফ্ল্যাট। এটি কেবল একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দের বিষয় নয়, এটি ছিল অসহায় মানুষের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেওয়ার মতো। এই ঘটনাটি পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সংকটের সবচেয়ে দুর্বল শিকারদের সাথে একটি নিষ্ঠুর প্রতারণা।

আশার পুনর্জন্ম: সরকারের দেরিতে হলেও টনক নড়ল

ব্যাপক সমালোচনার মুখে এবং গণমাধ্যমে বিষয়টি উঠে আসার পর সরকার অবশেষে সেই বিতর্কিত ৪,৪০৯ জনের তালিকাটি বাতিল করেছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনকে নতুন করে প্রকৃত জলবায়ু উদ্বাস্তুদের একটি স্বচ্ছ তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এই সিদ্ধান্তটি সেই সব বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য একটি বড় বিজয়, যারা রাজনীতির মারপ্যাঁচে নিজেদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। সমিতির পাড়ার একজন বাসিন্দা, যিনি নিজেও একজন ভুক্তভোগী, তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই সিদ্ধান্তে তারা সবাই খুশি। তাদের আশা, নতুন তালিকায় যেন প্রকৃত ভূমিহীন এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তরাই স্থান পায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় আর কেউ যেন এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত না হয়।

এই ঘটনা থেকে আমরা কী শিখলাম?

খুরুশকুলের এই ঘটনাটি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে:

১. জলবায়ু বিচার (Climate Justice) শুধু অবকাঠামো নয়: জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করাই যথেষ্ট নয়। সেই ভবনগুলোতে কারা আশ্রয় পাচ্ছে, সেটাই মূল বিষয়। যদি প্রকৃত ভুক্তভোগীরাই বাদ পড়ে যায়, তাহলে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও অর্থহীন। পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা মানে শুধু প্রকৃতির সাথে লড়াই নয়, এর সাথে জড়িত সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও জরুরি।

২. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিকল্প নেই: কীভাবে এত বড় একটি প্রকল্পে এমন দুর্নীতি সম্ভব হলো? এর মূল কারণ হলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। উপকারভোগী বাছাই প্রক্রিয়া যদি শুরু থেকেই স্বচ্ছ হতো, স্থানীয় কমিউনিটিকে যদি প্রক্রিয়ার অংশ করা হতো, তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত।

৩. তদারকি এবং পর্যবেক্ষণ: যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প, বিশেষ করে জলবায়ু অভিযোজন সংক্রান্ত প্রকল্পে, নিবিড় তদারকি অপরিহার্য। তালিকা তৈরি থেকে শুরু করে ফ্ল্যাট হস্তান্তর পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ না থাকলে, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয়।

শেষ কথা

খুরুশকুলের বিতর্কিত তালিকা বাতিল একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু আসল পরীক্ষা এখনো বাকি। নতুন তালিকাটি কতটা স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষভাবে তৈরি করা হয়, তার ওপরই নির্ভর করছে এই প্রকল্পের প্রকৃত সাফল্য। এই ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। এটি প্রমাণ করে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইটা কেবল প্রযুক্তি বা অর্থ দিয়ে জেতা যাবে না; এর জন্য প্রয়োজন সততা, মানবিকতা এবং সুশাসন।

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রকল্পে সামাজিক ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। আপনার প্রতিষ্ঠান কি এমন কোনো প্রকল্পে কাজ করছে যেখানে উপকারভোগী বাছাই এবং পর্যবেক্ষণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ? সঠিক কৌশল, কমিউনিটি সম্পৃক্ততা এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকল্পের সাফল্য নিশ্চিত করতে আমাদের বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলুন। আসুন, একসাথে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ