25.4 C
Bangladesh
শুক্রবার, মে ৩০, ২০২৫
spot_img

সেন্ট মার্টিন নিয়ে আমাদের ভুল ধারণা! কী বলছেন গবেষকেরা?

সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে অনেকেই বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ বলে জানেন। সরকারি বিভিন্ন নথি থেকে শুরু করে জনপ্রিয় ওয়েবসাইটেও এমন তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সামুদ্রিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি আসলে প্রবাল দ্বীপ নয়। বরং এটি একটি প্রবালসমৃদ্ধ পাথুরে দ্বীপ। অর্থাৎ দ্বীপটি প্রবালের কারণে তৈরি হয়নি, তবে এখানে প্রচুর প্রবাল রয়েছে। তাহলে এতদিন যা জানা ছিল, তা কি ভুল? সেন্ট মার্টিনের প্রকৃত পরিচয় কী? পরিবেশ ও জলবায়ুর দৃষ্টিকোণ থেকে এর গুরুত্বই বা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। সেন্ট মার্টিন নিয়ে আমাদের ভুল ধারণা

প্রবাল দ্বীপ বলতে আসলে কী বোঝায়?

প্রবাল দ্বীপ তখনই বলা হয়, যখন দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবাল দ্বারা গঠিত হয়। এই ধরনের দ্বীপ সাধারণত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবাল বৃদ্ধির ফলে গড়ে ওঠে। কিন্তু গবেষকদের মতে, সেন্ট মার্টিনের গঠন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি পাথর ও বালির স্তর দ্বারা তৈরি, যার চারপাশে কিছু প্রবাল প্রাচীর বা কলোনি রয়েছে। অর্থাৎ দ্বীপটি প্রবাল দিয়ে তৈরি হয়নি, বরং এখানে প্রবালের বসবাস রয়েছে। তাই একে প্রবাল দ্বীপ বলা বিভ্রান্তিকর হতে পারে।

গবেষকদের পর্যবেক্ষণ কী বলছে?

২০২২ সালে আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকী ‘সায়েন্স ডাইরেক্ট’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, সেন্ট মার্টিন মূলত পাললিক শিলা ও বালুর স্তর দিয়ে তৈরি। এই গবেষণা করেছিলেন কানাডার জীববিজ্ঞানী টমাস টমাসিক ও বাংলাদেশের দুই গবেষক মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ চৌধুরী ও মোহাম্মদ নুরুন্নবী। তারা বলছেন, ভুল চরিত্রায়ণের কারণে দ্বীপের প্রকৃত বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশগত গুরুত্ব উপেক্ষিত হচ্ছে।

সেন্ট মার্টিন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ চৌধুরী। তার মতে, এটি সম্পূর্ণ পাথুরে দ্বীপ, যেখানে প্রবাল জন্মানোর অনুকূল পরিবেশ থাকায় এখানে প্রবাল গড়ে উঠেছে। কক্সবাজারের পানির তুলনায় সেন্ট মার্টিনের পানি বেশি স্বচ্ছ। পানির লবণাক্ততা ও স্বচ্ছতা বেশি থাকার কারণেই এখানে প্রবাল গঠন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি প্রবাল দ্বীপ নয়। সেন্ট মার্টিন নিয়ে আমাদের ভুল ধারণা

ভুল ধারণার কারণে কী ক্ষতি হচ্ছে?

সেন্ট মার্টিনকে প্রবাল দ্বীপ হিসেবে প্রচার করার ফলে দ্বীপের বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশগত গুরুত্ব সঠিকভাবে বোঝা যাচ্ছে না। ফলে দ্বীপ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রেও নানা সমস্যা হচ্ছে।

পর্যটকদের বাড়তি চাপ সেন্ট মার্টিনের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর এখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ বেড়াতে আসেন। তাদের অবাধ চলাচল, প্লাস্টিক দূষণ, পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা এবং মাছ ধরার ট্রলার দ্বীপের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে, পর্যটকবাহী জাহাজ ও ট্রলারের নোঙর ফেলার কারণে প্রবাল ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে।

২০২০ সালে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়, ২০৪৫ সালের মধ্যে সেন্ট মার্টিন থেকে সব প্রবাল বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। শুধু প্রবাল নয়, এই দ্বীপে থাকা অলিভ রিডলে কাছিম, চার প্রজাতির ডলফিন, বিপন্ন সামুদ্রিক পাখি এবং আরও অনেক জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। পরিবেশবিদদের মতে, দ্বীপের প্রকৃত অবস্থা না বুঝে পর্যটন ও মৎস্যশিল্পকে প্রাধান্য দিলে দীর্ঘমেয়াদে আরও ক্ষতি হতে পারে।

সংরক্ষণ ছাড়া ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়। ২০২১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে, যার মধ্যে ছিল সৈকতে আলো জ্বালিয়ে বারবিকিউ নিষিদ্ধ করা, দোকানপাটে বেচাকেনা সীমিত রাখা, সৈকতের পাথর সংগ্রহ বন্ধ করা এবং যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করা। কিন্তু এসব নিয়ম পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

সেন্ট মার্টিন শুধু একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত সম্পদ। এখানে ২৫০টির বেশি প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবালসহ নানা জীববৈচিত্র্যের বসবাস। এদের টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

সঠিক তথ্য প্রচার এবং সচেতনতা জরুরি

গবেষকদের মতে, সেন্ট মার্টিনকে সরাসরি প্রবাল দ্বীপ না বলে প্রবালসমৃদ্ধ পাথুরে দ্বীপ বলা উচিত। এতে দ্বীপের প্রকৃত অবস্থান বোঝা সহজ হবে এবং সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পথ সুগম হবে। পরিবেশ রক্ষায় পর্যটকদেরও সচেতন হতে হবে। দ্বীপে গিয়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, প্রবাল বা সামুদ্রিক প্রাণীদের ক্ষতি না করা এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন নিশ্চিত করা জরুরি।

শেষ কথা

সেন্ট মার্টিন সম্পর্কে অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে। এটিকে প্রবাল দ্বীপ বলা হলেও গবেষকদের মতে, এটি আসলে প্রবালসমৃদ্ধ পাথুরে দ্বীপ। দ্বীপের পরিবেশ টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। পর্যটন, মৎস্যশিল্প ও পরিবেশ রক্ষার মধ্যে ভারসাম্য না রাখলে সেন্ট মার্টিনের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে। আপনি কী মনে করেন? সেন্ট মার্টিন সংরক্ষণে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার? মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ