বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, তার অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তবে বিগত বছরগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, প্লাস্টিক দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্বীপটি পরিবেশগত সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। দ্বীপের নাজুক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করেছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে কেবল দ্বীপকে দূষণমুক্ত করাই নয়, বরং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশগত ভারসাম্য নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য। সেন্ট মার্টিনে পরিচ্ছন্নতা অভিযান
সেন্ট মার্টিনে পরিচ্ছন্নতা অভিযান: উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় এই পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অভিযানে স্থানীয় ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক অংশগ্রহণ করেছেন, যারা দুই দিনব্যাপী এই কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এ ছাড়াও, বিগত দুই মাসে সাসটেইনেবিলিটি অ্যালায়েন্স নামক একটি সংস্থাও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালিয়েছে, যা দ্বীপের দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
দূষণ প্রতিরোধে গৃহীত কার্যক্রম
গত দুই মাসে সেন্ট মার্টিন থেকে বিপুল পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা, বিশেষত সিঙ্গেল-ইউজ প্লাস্টিক সংগ্রহ করা হয়েছে। সেন্ট মার্টিনে পরিচ্ছন্নতা অভিযান
- নদী ও সমুদ্র দূষণ রোধে জাহাজঘাট থেকে ২৪১ কেজি প্লাস্টিক ও ৮৭ কেজি পলিথিন অপসারণ করা হয়েছে।
- প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোরের মাধ্যমে সেন্ট মার্টিনে ১৪.৩ মেট্রিক টন এবং কক্সবাজারে ৬৭.৩ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই কার্যক্রম শুধু পরিচ্ছন্নতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি দ্বীপের বাসিন্দা ও পর্যটকদের প্লাস্টিক ব্যবহারে আরও দায়িত্বশীল হতে উৎসাহিত করছে।
পর্যটন নিয়ন্ত্রণ: পরিবেশ রক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
অত্যাধিক পর্যটকের আগমন সেন্ট মার্টিনের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। তাই দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
- ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে দৈনিক সর্বোচ্চ ২,০০০ পর্যটকের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
- গড়ে প্রতিদিন ১,৬৯৪ জন পর্যটক দ্বীপে প্রবেশ করেছেন, যা পূর্বের তুলনায় অনেক নিয়ন্ত্রিত।
- অতিরিক্ত যাত্রী বহনের দায়ে কয়েকটি জাহাজকে সতর্ক করা হয়েছে এবং দুটি জাহাজকে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য হল, দ্বীপের পরিবেশের ওপর পর্যটনের নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে এনে এক টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় ও পর্যটকদের জন্য উদ্যোগ
পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য শুধুমাত্র পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। এজন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে—
- তথ্যসংবলিত সাইনবোর্ড ও গ্রাফিতি স্থাপন: দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে পরিবেশ রক্ষার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
- বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি (BMC) গঠন:১০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ৬ জন লাইফগার্ড সার্বক্ষণিক দ্বীপের পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
- বিকল্প কর্মসংস্থান: স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে, যাতে তারা পর্যটনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল না থাকেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন—
“সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সবার। দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে তারা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করেন।”
সেন্ট মার্টিন রক্ষায় আমাদের করণীয়
সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। আপনি একজন পর্যটক বা স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে কী করতে পারেন?
✅ পর্যটক হিসেবে—
- দ্বীপে ভ্রমণের সময় প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য যেখানে-সেখানে না ফেলে নির্ধারিত জায়গায় ফেলুন।
- প্রবাল ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণে দায়িত্বশীল আচরণ করুন।
- দ্বীপের পরিবেশ বান্ধব হোটেল ও রিসোর্ট বেছে নিন।
✅ স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে—
- প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পর্যটনের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখুন।
- সরকারের নেওয়া উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করুন।
শেষ কথা
সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ, যার সৌন্দর্য ও পরিবেশগত গুরুত্ব অমূল্য। তবে এটি আমাদের অসচেতনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে বিপন্ন হচ্ছে। সরকার ও পরিবেশ সংস্থাগুলোর নেওয়া উদ্যোগগুলো দ্বীপকে বাঁচানোর এক বড় পদক্ষেপ।
আমাদের উচিত এই উদ্যোগে অংশগ্রহণ করা, পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া এবং পরিচ্ছন্ন সেন্ট মার্টিন গড়ার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করা। আপনার সামান্য সচেতনতাই আগামী প্রজন্মের জন্য এক সুস্থ ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে।
আপনি কীভাবে সেন্ট মার্টিন রক্ষায় অবদান রাখতে পারেন? আপনার মতামত ও পরামর্শ কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না!