রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী এক সময় ছিল দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তবে বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদী অনেকটাই ময়লা ও দূষিত। নদীর পানিতে এখন বহু ধরনের ময়লা, দূষণ এবং বর্জ্য পাওয়া যায়, কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী হিসেবে পরিচিত সাকার ফিশ। সাকার ফিশ একটি বিদেশী প্রজাতি, যা মূলত দক্ষিণ আমেরিকার জলাশয়ে পাওয়া যায়। এটি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক এবং দ্রুত বংশবিস্তারকারী। বুড়িগঙ্গায় সাকার মাছ সাফ
কিন্তু বুড়িগঙ্গায় এই সাকার ফিশের উত্থান কেন? এবং এটি পরিবেশে কীভাবে বিপদ সৃষ্টি করছে? এগুলো আমাদের জন্য একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুড়িগঙ্গার এই মাছের প্রজাতির সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম বুড়িগঙ্গার খ্যাতনামা মাঝি ফজলু মিয়ার কাছে, যিনি একাই এই সাকার ফিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন।
ফজলু মিয়ার সংগ্রাম: সাকার ফিশের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ
ফজলু মিয়া, একজন সাধারণ মাঝি, যিনি বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বেবি সাহেবের ঘাটে বসবাস করেন, গত এক বছর ধরে এককভাবে সাকার ফিশ ধরছেন। তার এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল বুড়িগঙ্গায় সাকার ফিশের উপদ্রব কমিয়ে আনা। ফজলু জানান, এক সময় বুড়িগঙ্গায় শিং মাছ ধরতে গিয়ে সাকার ফিশ আসত, কিন্তু গত বছর থেকে সাকার ফিশের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সাকার ফিশ এতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তিনি তা সহ্য করতে না পেরে এক সিদ্ধান্ত নেন: যতটা সম্ভব সাকার ফিশ ধরবেন এবং তা নদী থেকে বের করে ফেলবেন।
এটাই ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ। ফজলু মিয়া এখন এক প্রকার নায়ক হয়ে উঠেছেন, কারণ তিনি যেভাবে সাকার ফিশের উপদ্রব কমিয়েছেন, তা অনেকের কাছে চমকপ্রদ। বুড়িগঙ্গায় সাকার মাছ সাফ
সাকার ফিশের বিপদ এবং এর প্রভাব
সাকার ফিশের পিঠে ধারালো পাখনা থাকে এবং এটি মাছের মধ্যে অন্যতম আক্রমণাত্মক প্রজাতি হিসেবে পরিচিত। বিশেষত, এটি দেশীয় মাছের ডিম খেয়ে এবং খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট করে জীববৈচিত্র্যকে বিপদের মুখে ফেলেছে। সাকার ফিশের দ্রুত বংশবৃদ্ধির কারণে এটির প্রভাব বিভিন্ন জলাশয়ে পড়ছে। দেশের মৎস্য অধিদপ্তরও সাকার ফিশের বিপদ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রচারণা চালাচ্ছে।
ফজলু মিয়ার সংগ্রাম: বাস্তবতার মূলে
ফজলু মিয়ার সংগ্রাম শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্য নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও। তার কাজের মাধ্যমে তিনি যেন এক সমাজ সংস্কারের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন। তিনি জানালেন, এক সময় বুড়িগঙ্গায় সাকার ফিশের মতো মাছ এতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল যে, তা পায়ের নিচে পড়ত। বর্তমানে তার নেপথ্যে কাজ করা অবদান একে একে সবাই জানছে।
ফজলুর কর্মকাণ্ডে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাড়া পড়েছে। তার ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়ে গেছে, যেখানে দেখা যায়, তিনি সাকার ফিশ তুলে বিক্রি করছেন। যদিও শুরুতে তার কাছে সবাই মজা করত, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার সফলতা স্বীকৃত হয়েছে।
ফজলু মিয়ার পরিবার এবং জীবিকা
ফজলু মিয়া, যিনি পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলা থেকে ঢাকায় আসেন প্রায় ৩০ বছর আগে, বর্তমানে একটি ছোট পরিবারের সদস্য। তাঁর ছেলে লঞ্চের ডেকে পান বিক্রি করেন, আর ফজলু নিজে নদীতে সাকার ফিশ ধরেন। তাঁর সংসার টানাটানির হলেও, তিনি এক অবিশ্বাস্য সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তার পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।
বুড়িগঙ্গার ভবিষ্যৎ এবং সাকার ফিশ
এখন প্রশ্ন উঠেছে, এই পরিবর্তন কিভাবে স্থায়ী হবে? ফজলু মিয়া জানালেন, বর্ষাকালে সাকার ফিশ আবার ফিরে আসতে পারে। তবে, তিনি তখন আরো বড় জাল বোনাচ্ছেন, যাতে সাকার ফিশের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তার মতে, সাকার ফিশের সংখ্যা কমানো গেলে, বুড়িগঙ্গার অন্যান্য মাছের প্রজাতি আবার ফিরে আসবে এবং নদীর জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
এটি শুধু ফজলু মিয়ার একক সংগ্রাম নয়, বরং বুড়িগঙ্গার প্রতিটি মাঝি এবং নাগরিকের সংগ্রাম, যারা পরিবেশ রক্ষার জন্য একত্রিত হয়ে কাজ করবেন।
উপসংহার: আমাদের দায়িত্ব
ফজলু মিয়ার এই সাহসিকতা, নদী রক্ষার জন্য তার একক সংগ্রাম, আমাদের শেখাতে পারে যে পরিবেশ রক্ষা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, আমাদেরও ভূমিকা রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের ছোট ছোট উদ্যোগ বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হতে পারে। সাকার ফিশের মতো পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক প্রজাতির নিয়ন্ত্রণে আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আমাদের নদীগুলোর স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
Call-to-Action আপনার মতামত শেয়ার করুন! আপনি কি মনে করেন, ফজলু মিয়ার মতো ব্যক্তিরা আমাদের পরিবেশের জন্য আরও ভূমিকা রাখতে পারেন? কমেন্ট করুন এবং আমাদের আরও পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদন পড়তে সাবস্ক্রাইব করুন!