বাংলাদেশের নদী, নালা এবং জলাশয়গুলোতে এক সময় প্রচুর গোটালি মাছ (Crossochelius latius) পাওয়া যেত। তবে পরিবেশগত পরিবর্তন, জলবায়ু সমস্যা এবং মানুষের অবাধ ক্রিয়াকলাপে এই মাছটি হারিয়ে যেতে বসেছিল। তবে এখন, একটি সুখবর এসেছে—গোটালি মাছ পুনরুদ্ধারের জন্য সফল গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া গবেষণার মাধ্যমে গোটালি মাছের কৃত্রিম প্রজনন এবং পোনা উৎপাদন কৌশল সফল হয়েছে। এই উদ্যোগটি বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিস্থিতির জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। হারিয়ে যাওয়া গোটালি
গোটালি মাছ: এক ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য
গোটালি মাছ সুস্বাদু এবং পুষ্টিমানের জন্য পরিচিত, এবং এটি একসময় বাংলাদেশের নদী-নালাগুলোর আদর্শ বাসিন্দা ছিল। মাছটির দৈর্ঘ্য সাধারণত ১২ সেন্টিমিটার এবং ওজন ১৫-১৭ গ্রাম হয়ে থাকে। এর শরীর লম্বা, মাথা চ্যাপ্টা এবং অত্যন্ত পুষ্টিমানে ভরপুর। এই মাছটি মূলত মিঠাপানি জলাশয়, পাহাড়ি ঝরনা এবং অগভীর স্বচ্ছ নদী অঞ্চলে বাস করত। উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ও আত্রাই নদীসহ সিলেটের পিয়াইন এবং পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদীতেও এক সময় প্রচুর পরিমাণে এই মাছ পাওয়া যেত। তবে ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) গোটালি মাছকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করে।
গোটালি মাছের প্রজনন কৌশলের সফলতা
গোটালি মাছ পুনরুদ্ধারে গবেষণার প্রথম ধাপ ছিল কৃত্রিম প্রজনন কৌশল তৈরি করা। সৈয়দপুরের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণাটি শুরু করেন ২০২৩ সালে। তাদের চেষ্টা সফল হয়েছে, এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে গোটালি মাছের পোনা চাষিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। গবেষণার ধারাবাহিকতায়, গোটালি মাছের পোনা উৎপাদন এখন সম্ভব হয়েছে, যা নদী-নালায় ফিরে আসার জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। গবেষকরা জানিয়েছেন, ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে গোটালি মাছের প্রজনন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং সঠিক পরিচর্যায় মাত্র ৫০-৬০ দিনের মধ্যে পোনা বড় হয়ে উঠতে পারে। হারিয়ে যাওয়া গোটালি
গোটালি মাছের ভবিষ্যৎ
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই মাছটি ফিরে আসলে নদী-নালা এবং খাল-বিলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য পুনঃস্থাপন হবে। ইতিমধ্যে, মাছটির কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি সফল হয়েছে এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি থেকে এটি চাষিদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এই মাছটি এক সময় দেশের ঐতিহ্যের অংশ ছিল, তবে মানুষের অবাধ শিকারে এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে এটি বিলুপ্তির দিকে চলে গিয়েছিল। এখন, একটি সাফল্যের পর নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
গোটালি মাছের পুনরুদ্ধারে গবেষণার কাজ আরো এগিয়ে যাওয়ার কারণে, এটি শুধু পরিবেশগত পুনঃস্থাপন নয়, একই সঙ্গে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের সমৃদ্ধি এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দিকে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। গবেষকদের দাবি, এই ধরনের গবেষণা বাংলাদেশের জলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
গোটালি মাছের মতো অন্যান্য প্রাণীও পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের নদী, খাল ও জলাশয়গুলোর শর্ত পরিবর্তন হওয়ায়, বিশেষ করে দুষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। গোটালি মাছের প্রজনন হুমকির মুখে পড়েছিল, এবং তা অনেকটা অবহেলা ও ভুল ব্যবস্থাপনার ফলস্বরূপ। তাই, এই ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশের জলবায়ু পরিস্থিতি এবং পরিবেশের ভবিষ্যত রক্ষায় একটি মাইলফলক হতে পারে।
এই উদ্যোগটির মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা ও প্রাকৃতিক সম্পদের পুনঃস্থাপনের একটা আলো দেখা যাচ্ছে। আমাদের সচেতনতা এবং পরিবেশগত দায়িত্ববোধের মাধ্যমে, অন্যান্য বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির পুনরুদ্ধারও সম্ভব হতে পারে।
শেষ কথা
গোটালি মাছের পুনরুদ্ধার প্রকল্প শুধু বাংলাদেশের জলবায়ু এবং পরিবেশ ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি আমাদের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধের এক সুন্দর উদাহরণ। এই সফল উদ্যোগটি দেশের অন্যান্য নদী এবং জলাশয়ের জীববৈচিত্র্য পুনঃস্থাপনেও ভূমিকা রাখতে পারে।
এছাড়া, এই ধরনের গবেষণায় আমাদের আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে যাতে আরও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
আপনার কী মতামত? আপনি কি মনে করেন যে এই ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না!