শ্রীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের সাইটালিয়া, তালতলী ও মুরগির বাজার এলাকায় আজ এক ব্যতিক্রমী দৃশ্যের জন্ম হয়েছে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাবসহ যৌথ বাহিনী শুরু করেছে এক বিশাল অভিযান— শ্রীপুরে বনের জমি উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান।
এই অভিযান শুধু জমি উদ্ধার নয়, এটি একটি বড় বার্তা বহন করে: পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষার সংকল্প।
জমি উদ্ধারের প্রেক্ষাপট
বন বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিল যে গাজীপুরের শ্রীপুর অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বনভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে। তেলিহাটি ও পেলাইদ মৌজায় অন্তত চার একর বনভূমি অবৈধভাবে বসবাসকারীদের দ্বারা দখল হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে অন্তত ৪৬টি পাকা ও আধা পাকা স্থাপনা গড়ে উঠেছিল, যা শুধু পরিবেশ নয়, স্থানীয় বাস্তুসংস্থানের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
পরিবেশবাদীরা বহুদিন ধরে এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। আজকের অভিযান এই সমস্যার একটি সমাধানমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অভিযানের বাস্তব চিত্র
আজ শনিবার সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান ছিল সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী। বড় এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে অবৈধ স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।
অভিযান চলাকালে আবেগঘন কিছু মুহূর্তও তৈরি হয়েছে। বাসিন্দারা কান্নাকাটি করছেন, কেউ কেউ জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন—একটি মানবিক ট্র্যাজেডিও আমরা দেখছি।
মোসা. কল্পনা আক্তার নামে এক নারী তাঁর ভেঙে ফেলা বাড়ির পাশে বসে বলছিলেন,
“শইল্লের রক্ত পানি কইরা টাকা জমাইয়া এই বাড়িটা করছিলাম। বাড়িডা ভাইঙা দিছে। অহন ঝি-পুত লইয়া আমি কই যাইয়াম।”
অন্যদিকে শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. আবদুল্লাহ আল মামুন এবং সোহেল রানা তাঁদের পরিবার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বহু বছর ধরে সেখানে বসবাসের কারণে এলাকাবাসীর মধ্যে আবেগ জন্মে গিয়েছিল, যা এই উচ্ছেদের সময় প্রকাশ পেয়েছে।
আইনগত দিক এবং প্রশাসনের অবস্থান
শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মোখলেসুর রহমান জানিয়েছেন, উচ্ছেদের আগে একাধিকবার নোটিশ প্রদান, লিফলেট বিতরণ এবং মাইকিং করা হয়েছিল। অর্থাৎ, এই উচ্ছেদ আকস্মিক কোনো সিদ্ধান্ত নয়; এটি দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার ফলাফল।
তিনি আরও জানান, উদ্ধারকৃত বনভূমির প্রচলিত বাজার মূল্য ২০ কোটি টাকারও বেশি। এই জমিগুলো পরিবেশগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সজীব আহমেদ। তাঁর ভাষায়,
“বনের জমি উদ্ধারে অভিযান চালানো হচ্ছে। দিনভর অভিযান চলবে।”
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অভিযান পরিচালনা করছে, যাতে কোনো বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা না ঘটে।
কেন এই জমি উদ্ধারে অভিযান জরুরি ছিল?
আজকের এই অভিযান শুধুমাত্র জমি উদ্ধার নয়, বরং বৃহত্তর পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের অংশ। বনভূমি হারালে—
- কার্বন শোষণের ক্ষমতা কমে যায়, যা জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করে।
- জীববৈচিত্র্যের হুমকি তৈরি হয়।
- স্থানীয় মানুষের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ে।
বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশে প্রতিটি গাছ, প্রতিটি একর বনভূমি রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রীপুরের এই বনভূমি কেবল স্থানীয় নয়, জাতীয় পরিবেশ সুরক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি: বসবাসকারীদের দুর্দশা
একদিকে পরিবেশ রক্ষার জরুরি প্রয়োজন, অন্যদিকে বহু বছরের বসবাসের স্মৃতি ও জীবন সংগ্রামের কষ্ট। উচ্ছেদের ফলে বহু পরিবার এখন ঘরহারা হয়েছে, যা এক মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে।
এক্ষেত্রে প্রশাসনের দায়িত্ব হবে বিকল্প পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে তারা খোলা আকাশের নিচে না পড়ে। উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষা: ভবিষ্যতের জন্য করণীয়
আজকের ঘটনা থেকে আমরা কয়েকটি শিক্ষা নিতে পারি:
- বনভূমি বা সরকারি জমি দখলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ সময়মত নিতে হবে।
- সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে যে পরিবেশ ধ্বংসের ফলাফল আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হবে।
- পুনর্বাসন নীতিমালা তৈরি করে মানবিক সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষার জন্য এ ধরনের অভিযান চালানো প্রয়োজন, তবে মানুষের জীবন-জীবিকাকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
শেষ কথা
শ্রীপুরে বনের জমি উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান ছিল একটি সময়োপযোগী এবং জরুরি পদক্ষেপ। তবে এটি আমাদের সামনে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জও তুলে ধরেছে। পরিবেশ রক্ষা করতে গিয়ে যেন কোনো নিরীহ মানুষ নিঃস্ব না হয়, সে বিষয়েও আমাদের সজাগ থাকতে হবে।
পরিবেশ, জলবায়ু এবং মানবিকতা—এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতেই হবে।
আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না—কমেন্টে জানান, আপনার কী মনে হয় এই অভিযান সম্পর্কে? আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য আপনি আর কী কী পদক্ষেপ জরুরি মনে করেন?