25.7 C
Bangladesh
শুক্রবার, মে ৩০, ২০২৫
spot_img

পুড়ে যাওয়া সুন্দরবনে সবুজের অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন: স্যাটেলাইট দেখাল চমকপ্রদ তথ্য!

পৃথিবী আজ জলবায়ু পরিবর্তনের এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তীব্র তাপপ্রবাহ, অপ্রত্যাশিত বন্যা, ঘূর্ণিঝড় – এসবই যেন প্রকৃতির এক নীরব প্রতিবাদ। আর এই পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমাদের পরিবেশ এবং তার উপাদানগুলোর উপর। বাংলাদেশের ফুসফুস ও প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ সুন্দরবনও এর ব্যতিক্রম নয়। নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই ম্যানগ্রোভ বন প্রায়শই ক্ষতির শিকার হয়, যার মধ্যে অন্যতম হলো অগ্নিকাণ্ড। স্যাটেলাইট দেখাল চমকপ্রদ তথ্য

গত বছর, ৪ মে পূর্ব সুন্দরবনের আমোরবুনিয়া এলাকায় ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সেই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার, কোস্ট গার্ড ও বন বিভাগকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। ৬ মে দুপুরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো)-এর স্যাটেলাইট ছবিতে উঠে আসে আরও উদ্বেগজনক তথ্য – আগুন আসলে লেগেছিল আরও চার দিন আগে! এই ঘটনায় সুন্দরবনের প্রায় ৭ হেক্টর এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। বন বিভাগের জন্য, পরিবেশপ্রেমীদের জন্য, পুরো দেশের জন্যই এটি ছিল এক বিশাল ধাক্কা। স্যাটেলাইট দেখাল চমকপ্রদ তথ্য

কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব নিরাময় ক্ষমতা হয়তো মানুষের সব হিসাবকে ছাড়িয়ে যায়। সম্প্রতি স্পারসোর এক গবেষণা থেকে উঠে এসেছে তেমনই এক চমকপ্রদ তথ্য, যা আমাদের নতুন করে আশা দেখাচ্ছে।

আকাশের চোখ দিয়ে দেখা সুন্দরবনের পুনরুদ্ধার

স্পারসো এই পুড়ে যাওয়া এলাকার উপর নিয়মিত নজর রাখছিল স্যাটেলাইট ক্যামেরার মাধ্যমে। তাদের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক বছরের মধ্যে এই ৭ হেক্টর পুড়ে যাওয়া জায়গার প্রায় ৩.৯ হেক্টর এলাকা প্রাকৃতিকভাবেই সবুজে ভরে উঠেছে! অর্থাৎ, পোড়া জমির প্রায় ৫৭% এলাকা আবার পাতা ও গুল্ম দিয়ে আচ্ছাদিত হয়েছে। নতুন ছোট ছোট গাছও জন্মাচ্ছে সেখানে। স্যাটেলাইট দেখাল চমকপ্রদ তথ্য

স্পারসোর স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। যেমন, ২০২৪ সালের (সম্ভবত ২০২৩ সাল হবে, যেহেতু ঘটনাটি গত বছরের) ৩০ এপ্রিল সুন্দরবনের এই নির্দিষ্ট স্থানে পুড়ে যাওয়া জায়গার পরিমাণ ছিল প্রায় ১.৬ হেক্টর (সম্ভবত পুরনো আগুন বা ছোটখাটো ঘটনা)। কিন্তু ১০ মে-র স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, আগুন লাগার পর পুড়ে যাওয়া জায়গার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৯ হেক্টর প্রায়। ঠিক এক বছর পর, একই স্থানের স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে স্পারসো দেখেছে যে ৩.৯ হেক্টর জায়গা আবার সবুজে আচ্ছাদিত হয়ে গেছে।

গবেষণা বলছে, এই পুনরুদ্ধার মানে হলো এলাকাটি সবুজ পাতা এবং ছোট গুল্ম দ্বারা আবৃত হয়েছে। বড় কাঠের গাছপালার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আরও কিছুটা সময় লাগবে, যা বনের বাস্তুতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই হারে প্রাকৃতিকভাবে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলতে থাকলে আগামী এক বছরের মধ্যেই পুড়ে যাওয়া পুরো এলাকা সবুজ পাতা এবং গুল্মে ভরে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রকৃতির নিজস্ব নিরাময় ক্ষমতা: স্পারসো কী বলছে?

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) সদস্য ড. মাহমুদুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গত বছর সুন্দরবনে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনাটি সবাইকে ব্যথিত করেছিল। বনভূমির বিরাট একটি এলাকা পুড়ে যাওয়া ছিল অত্যন্ত কষ্টের। সেই থেকেই স্পারসো সুন্দরবনের এই জায়গাটিকে নিবিড়ভাবে মনিটরিংয়ে রাখছিল।

তিনি বলেন, তারা খেয়াল করছিলেন যে, প্রাকৃতিকভাবেই সবুজ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ৫ এপ্রিলের (সম্ভবত ২০২৪ সালের ৫ এপ্রিলের স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে) স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেল, এক বছরে প্রায় ৩.৯ হেক্টর জায়গায় নতুনভাবে সবুজ ফিরে এসেছে। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য বন বিভাগের সহযোগিতায় তারা সুন্দরবনের সেই নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিনিধিও পাঠিয়েছিলেন। মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণেও দেখা গেছে, সত্যিকার অর্থেই প্রাকৃতিকভাবে বন পুনরুদ্ধার হয়েছে এবং প্রক্রিয়াটি এখনো অব্যাহত আছে। স্পারসো বন বিভাগকে এই পুরো বিষয়টি জানিয়েছে।

ড. মাহমুদুর রহমান আরও যোগ করেন যে, ২০১৪ সালের ৪ মে (সম্ভবত ২০২৩ সালের) সুন্দরবনে আগুন লেগেছিল, যদিও ঘটনাটি তার ৩-৪ দিন আগের। স্পারসো আগুনের ঘটনাটি স্যাটেলাইট ইমেজে দেখার জন্য ফ্রি ডেটা সেন্টিনেল-২ এবং ল্যান্ডস্যাট ব্যবহার করে। ২৪ ও ৩০ এপ্রিল এবং ১০ মে-র তিনটি ডেটা বিশ্লেষণ করে তারা ৭ হেক্টরের মতো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করেন। ২০১৯-২০২৩ সালের ডেটা বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন যে, আগুন লাগার আগে এলাকাটিতে গাছপালার গড় উচ্চতা ২-৩ মিটার ছিল। স্যাটেলাইট চিত্রে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাটি সুন্দরবনের সীমানা থেকে ১৭৫ মিটার ভেতরে অবস্থিত ছিল।

এই পুনরুদ্ধার আমাদের কী বার্তা দেয়?

সুন্দরবনের পুড়ে যাওয়া অংশে প্রকৃতির এই স্বতঃস্ফূর্ত নিরাময় ক্ষমতা সত্যিই বিস্ময়কর এবং আশাব্যঞ্জক। এটি প্রমাণ করে যে, প্রকৃতিতে প্রতিকূলতা সহ্য করার এবং নিজেকে পুনর্গঠন করার অসাধারণ শক্তি রয়েছে। কিন্তু একই সাথে এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতির এই ক্ষমতা অসীম নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের (যেমন অগ্নিকাণ্ড) সংখ্যা বাড়লে প্রকৃতির পক্ষে একা এই ধকল সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।

সুন্দরবন কেবল একটি বন নয়, এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস, অসংখ্য প্রজাতির আবাসস্থল এবং উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক ঢাল। এর সুরক্ষা মানে আমাদের নিজেদের সুরক্ষা। প্রকৃতির এই দান, পুড়ে যাওয়া বনে সবুজের ফিরে আসা, আমাদের জন্য এক বার্তা – প্রকৃতিকে তার নিজের গতিতে সুস্থ হওয়ার সুযোগ করে দিন। আর সেই সুযোগ তৈরি হবে তখনই যখন আমরা পরিবেশের উপর চাপ কমানো, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সচেতন হওয়া এবং বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করব।

প্রকৃতির এই ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে আপনি কী করতে পারেন?

সুন্দরবনের এই ঘটনা আমাদের দেখায় যে প্রকৃতি অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী। কিন্তু প্রকৃতির এই শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে আমাদেরও অবদান রাখা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ রক্ষায় আপনিও আপনার জায়গা থেকে অংশ নিতে পারেন। কিভাবে?

১. সচেতনতা বৃদ্ধি: পরিবেশগত সমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে নিজে জানুন এবং অন্যদের জানান।

২. সংরক্ষণ উদ্যোগে সহায়তা: সুন্দরবন বা অন্যান্য বনভূমি সংরক্ষণে কাজ করা বিশ্বস্ত পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোকে আর্থিক বা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য করুন। আপনার ছোট আর্থিক সহায়তাও প্রকৃতির এই নিরাময় প্রক্রিয়াকে বেগবান করতে পারে।

৩. পরিবেশ-বান্ধব জীবনযাপন: প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, গাছ লাগানো, শক্তি সাশ্রয় করা, পুনর্ব্যবহার – আপনার দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট পরিবর্তন পরিবেশের উপর বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

৪. দায়িত্বশীল কেনাকাটা: পরিবেশের উপর কম প্রভাব ফেলে এমন পণ্য বা সেবা বেছে নিন। পরিবেশ-বান্ধব উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোকে সমর্থন করুন। আপনার কেনাকাটার সিদ্ধান্তও প্রকৃতির সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারে।

পোড়া বনে সবুজের ফিরে আসা প্রকৃতির এক অসাধারণ দান। আসুন আমরা সবাই মিলে এই দানের মর্যাদা রাখি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রকৃতিকে সাহায্য করি। আপনার বারান্দায় একটি গাছ লাগানো থেকে শুরু করে পরিবেশ সংরক্ষণে আর্থিক সহায়তা – প্রতিটি পদক্ষেপই গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি কি পরিবেশ রক্ষায় বা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন? নিচে মন্তব্য করে আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে ভাগ করে নিন। আপনার মতামত অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ