শেরপুরের বন বিভাগ একটি অসুস্থ হাতির প্রতি অসাধারণ মমতা ও নিবেদন দেখিয়েছে, যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব এবং পরিবেশ ও প্রাণিকল্যাণের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে তুলে ধরেছে। এই হৃদয়স্পর্শী গল্পটি বনের অসুস্থ হাতির জন্য অন্য রকম ভালোবাসা-র দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এবং আমাদের গ্রহের অন্যান্য প্রাণীদের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই গল্পটি আরও দেখায় যে জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে তাদের আবাসস্থলকে প্রভাবিত করছে, যার কারণে তারা তাদের ঘর ছেড়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। একটি অসুস্থ হাতি
সাহায্যের আহ্বান: একটি বিপন্ন হাতি
গত ১৫ই এপ্রিল শেরপুরের নালিতাবাড়ী সীমান্তের গারো পাহাড়ের লোকালয়ে ৪০-৪৫টি হাতির একটি দল নেমে আসে। সেই দলে একটি হাতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। সামনের ডান পা ফোলা থাকায় একসময় সেটি দলছুট হয়ে পড়ে। একজন স্থানীয় বাসিন্দা হাতিটিকে দেখতে পেয়ে দ্রুত বন বিভাগকে খবর দেন।
পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বন বিভাগ বন্য হাতিটিকে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৭শে এপ্রিল থেকে বনকর্মীদের দল হাতিটিকে খুঁজতে এক টিলা থেকে অন্য টিলায় ঘুরতে শুরু করে। ৩০শে এপ্রিল অবশেষে তারা কাটাবাড়ী এলাকার জঙ্গলে হাতিটিকে খুঁজে পায়। সঙ্গে সঙ্গেই গাজীপুর সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন ডাঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানকে খবর দেওয়া হয়। তিনি বিশেষজ্ঞ দল নিয়ে রাতেই মধু টিলা ইকোপার্ক অফিসে পৌঁছান। একটি অসুস্থ হাতি
সংবেদনশীল একটি অভিযান: একটি নিরীহ প্রাণীর চিকিৎসা
১লা মে সকাল ১০টার দিকে হাতিটিকে কাটাবাড়ীর একটি জলাশয়ের পাশে ঝিমোতে দেখা যায়। দূর থেকে ট্রানকুইলাইজার বন্দুক দিয়ে তাকে অচেতন করা হয়। এরপর শুরু হয় এক জটিল ও সময়সাপেক্ষ অভিযান। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে দলটি হাতির আঘাতের চিকিৎসা করে।
এই দলে ছিলেন ডাঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, ল্যাব টেকনিশিয়ান আতিকুর রহমান ভূঁইয়া, ভেটেরিনারি সার্জন সাকিব হোসেন, সহকারী মোস্তফা কামাল, শেরপুর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ শাহিন কবির, বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা সুমন সরকার, ওয়াইল্ডলাইফ রেঞ্জার মোঃ আবদুল্লাহ আল আমিন, মধু টিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ দেওয়ান আলী এবং সমশ্চুড়া বিট কর্মকর্তা মোঃ কাউসার হোসেন।
চিকিৎসকরা জানান, ১০ থেকে ১২ বছর বয়সী হাতিটির সামনের ডান পায়ে ধারালো অস্ত্রের পুরোনো ক্ষত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, দেড় থেকে দুই মাস আগে কেউ বল্লম জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করেছিল। সেই ক্ষতস্থানে পচন ধরে গিয়েছিল। ক্ষত পরিষ্কার করে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় এবং ব্যান্ডেজ করা হয়। এরপর বিশেষ ইনজেকশন দিয়ে হাতিটিকে জাগিয়ে তোলা হয়। ২০-২৫ মিনিট পর হাতিটি জঙ্গলের ভেতরে চলে যায়। একটি অসুস্থ হাতি
স্থানীয়দের সচেতনতা ও সহযোগিতা: একটি মূল্যবান সম্পদ
অসুস্থ হাতিটির বিষয়টি প্রথম নজরে আসে বন্যপ্রাণীপ্রেমী স্থানীয় বাসিন্দা কাঞ্চন মারাকের। তিনি জানান, গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি প্রথম হাতিটিকে অসুস্থ অবস্থায় দেখেন। তিনি বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেন, যার ফলস্বরূপ বন বিভাগ দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।
কাঞ্চন মারাকের মতো স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতনতা ও সহযোগিতা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সাহায্য ছাড়া বন বিভাগের পক্ষে দ্রুত অসুস্থ বা বিপন্ন প্রাণীদের খুঁজে বের করা এবং তাদের সুরক্ষা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ত।
পুনরায় চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণ: নিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে
দ্বিতীয় দফায় ১৭ই মে রাতে বিশেষজ্ঞ দলটি আবারও মধু টিলায় আসে। পরদিন সকালে প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে খোঁজাখুঁজির পর বড়খোল জঙ্গলে হাতিটির অবস্থান পাওয়া যায়। আবারও অচেতন করে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
চিকিৎসকরা জানান, হাতিটির ক্ষতস্থানের ৮০ শতাংশ সেরে গেছে, তবে পায়ের ফোলাভাব পুরোপুরি কমেনি। ওষুধ দেওয়া হয়েছে। এরপর ২১শে মে দুপুরে বন বিভাগের দল আবারও হাতিটির খোঁজ নেয় এবং কলাগাছ ও ধানসহ বিভিন্ন খাবার দেওয়া হয়। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত হাতিটির গতিবিধি নজরে রাখা হবে এবং প্রয়োজনে আবারও চিকিৎসা দেওয়া হবে।
মধু টিলা ইকোপার্কের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ দেওয়ান আলী জানান, হাতিটি বল্লমের আঘাতে আহত হয়েছিল। তিনি বলেন, “হাতিটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলত। চিকিৎসা দিতে পেরে ভালো লাগছে। এখনো নজরদারিতে রেখেছি, প্রয়োজনে আবারও চিকিৎসা দেওয়া হবে।”
শেরপুরের প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ শাহিন কবির জানান, অসুস্থ হাতির খবর পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। এরপর সীমান্তবর্তী এলাকায় তাকে দুই দফায় চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বন্য হাতিকে বনে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার ঘটনা দেশে সম্ভবত এটাই প্রথম।
মানুষ ও হাতির সহাবস্থান: একটি টেকসই সমাধান
প্রতি বছরই ধান ও কাঁঠালের মৌসুমে খাবারের সন্ধানে হাতি লোকালয়ে নেমে আসে এবং ফসল রক্ষার জন্য মাঠে থাকা মানুষের সঙ্গে তাদের সংঘাত হয়। এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। তবে, এবারের ঘটনা ভিন্ন। অসুস্থ হাতির জন্য বন বিভাগের এগিয়ে আসা মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে সহাবস্থানের একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ শুধু বন বিভাগের দায়িত্ব নয়, বরং আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমাদের উচিত এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে মানুষ ও বন্যপ্রাণী উভয়েই নিরাপদে বসবাস করতে পারে।
করণীয়:
- বন্যপ্রাণী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করুন।
- স্থানীয় বন বিভাগ ও পরিবেশ সংস্থাগুলোকে সহায়তা করুন।
- বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল রক্ষায় কাজ করুন।
- পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করুন।
আসুন, আমরা সবাই মিলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে এগিয়ে আসি এবং একটি সুন্দর ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি।