বন বিভাগ টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনকে তার আগের রূপে ফিরিয়ে আনার এক উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ নিয়েছে। আগ্রাসী প্রজাতি অপসারণ এবং স্থানীয় শাল গাছ পুনঃস্থাপনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে এই পুনরুদ্ধার প্রকল্পটি বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন করে নিবেদিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। মূল বিষয় হলো, “শালবনে আবার শালগাছই ফেরত আনা হবে,” পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এই কথাটি বলেছেন। মধুপুর শালবন
পুনরুদ্ধারের একটি স্বপ্ন: সমস্যার মূলোৎপাটন, ভবিষ্যতের বপন
পরিকল্পনাটিতে একটি পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে: প্রথমত, বনের সীমানা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা। এর পরে, আগ্রাসী, অ-স্থানীয় প্রজাতি যেমন ইউক্যালিপটাস এবং আকাশমণি, যা বাস্তুতন্ত্রকে গ্রাস করেছে, সেগুলোকে ধীরে ধীরে নির্মূল করা হবে। এই আক্রমণাত্মক প্রজাতিগুলি শাল গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। স্থানীয় শাল (গজারি) গাছ এবং এর সহযোগী প্রজাতিগুলি তখন বনের আসল গঠন পুনরুদ্ধার করতে রোপণ করা হবে। মধুপুর শালবন
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান রবিবার মধুপুর শালবন পুনরুদ্ধার প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা দেন। অনুষ্ঠানে শাল চারা রোপণ, বনের সীমানা চিহ্নিতকরণ এবং ময়ূর ও কচ্ছপ অবমুক্তকরণ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অংশীদারিত্ব ও পুনর্মিলন: টেকসইয়ের পথ
বনের তেলকী এলাকায় শাল গাছের চারা রোপণের পর সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জোর দিয়ে বলেন যে শালবনে শাল গাছ ফিরিয়ে আনাই তাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, “বর্ষাকালে শাল গাছ লাগানোর মাধ্যমে এই কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।” তিনি পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় বনের ভেতরে বসবাসকারী স্থানীয় সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করার গুরুত্বের ওপরও জোর দেন। প্রকল্পটি শালবনের সীমানা চিহ্নিত করাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, কারণ বনভূমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। মধুপুর শালবন
শালবন থেকে ইউক্যালিপটাস গাছ পর্যায়ক্রমে সরিয়ে সেখানে ৭০/৩০ অনুপাতে শাল ও তার সহযোগী গাছগুলি আনা হবে। বন বিভাগের সাথে বনে বসবাসকারীদের যে মামলা-মোকদ্দমা আছে, সেগুলোর মধ্যে ১২৯টি মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা তিনি দিয়েছেন। এছাড়া, বন বিভাগের অনেক মামলায় শুধু শুধু অনেক টাকা ও সময় ব্যয় হয়; কিন্তু ফল আসে না, সেই মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিশ্বাস করেন, বন বিভাগ এবং বনে বসবাসকারীদের মধ্যেকার দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারলে তাদের অংশগ্রহণে এই বনকে আবারও ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
প্রকৃতির মুক্তি: ময়ূর ও কচ্ছপের প্রত্যাবর্তন
অনুষ্ঠানে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বনাঞ্চলের রাজাবাড়ী এলাকায় সীমানা পিলার স্থাপনের মাধ্যমে বনভূমির সীমানা চিহ্নিতকরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। পরে লুহুরিয়া এলাকায় হরিণ প্রজননকেন্দ্রে নির্মিত শেডে ১০টি ময়ূর এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে ৭৩টি কচ্ছপ অবমুক্ত করেন। বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ময়ূরগুলোকে আপাতত শেডে আবদ্ধ করে রাখা হবে। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর উন্মুক্ত বনে ছেড়ে দেওয়া হবে।
এই পদক্ষেপগুলি শুধুমাত্র প্রতীকী নয়, বরং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য। কচ্ছপ, যা পরিবেশের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে পরিচিত, তারা জলাভূমি পরিষ্কার রাখে এবং ময়ূর খাদ্য শৃঙ্খলকে সচল রাখতে সাহায্য করে।
স্থানীয় কণ্ঠস্বর: সাফল্যের চাবিকাঠি
দুপুরে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মধুপুরের দোখলা জাতীয় উদ্যান মাঠে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে বন বিভাগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। অনুষ্ঠানে গারো জাতিগোষ্ঠীর প্রবীণ নেতা অজয় এ মৃ এবং জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেকসহ আরও অনেকে বক্তব্য রাখেন।
জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, ‘বনে বসবাসকারীদের সম্পৃক্ত করে মধুপুরের শালবনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ বন বিভাগ নিয়েছে। এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। এর মধ্য দিয়ে বনে বসবাসকারী আদিবাসীদের ভূমি সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করি।’
স্থানীয় আদিবাসীদের সম্পৃক্ত করা এই প্রকল্পের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বনকে রক্ষা করা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
আমাদের করণীয়: সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রক্ষা করি সবুজ
মধুপুর শালবনকে তার আগের রূপে ফিরিয়ে আনার এই উদ্যোগ একটি আশার আলো দেখাচ্ছে। এই প্রচেষ্টা সফল করতে আমাদের যা করতে হবে:
- সচেতনতা বৃদ্ধি: এই প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে এবং অন্যদের জানাতে উৎসাহিত করুন।
- টেকসই জীবনযাপন: পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করুন এবং অপচয় কমান।
- সংরক্ষণ সংস্থাকে সহায়তা: পরিবেশ রক্ষায় কাজ করা সংস্থাগুলোকে অনুদান দিন বা তাদের কার্যক্রমে অংশ নিন।
- সরকারের নীতি সমর্থন: পরিবেশ সুরক্ষার জন্য সরকারের গৃহীত নীতি ও পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানান।
আসুন, সবাই মিলে শপথ নেই—আমরা আমাদের বনকে রক্ষা করব, পরিবেশকে বাঁচাব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলব।