পর্যটকদের কাছে ‘স্বর্গীয় সৌন্দর্যের’ প্রতীক সিলেটের জাফলং। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই সেই সৌন্দর্যের বুকে ছুরিকাঘাত করে চলছিল অবৈধ পাথর উত্তোলনের মহাযজ্ঞ। বিকট শব্দ আর ধুলার আস্তরণে ঢাকা পড়েছিল জাফলংয়ের সবুজ। তবে দেরিতে হলেও সেই কান্না থামাতে এবার কোমর বেঁধে নেমেছে প্রশাসন। বন্ধ হলো ৭৭টি পাথর ভাঙার যন্ত্র
গতকাল বুধবার (২৫ জুন) জাফলংয়ে একযোগে অভিযান চালিয়ে ৭৭টি অবৈধ পাথর ভাঙার যন্ত্রের (ক্রাশার মেশিন) বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে টাস্কফোর্স। এটি নিছক কোনো বিচ্ছিন্ন অভিযান নয়, বরং দেশের অন্যতম প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এই এলাকাকে বাঁচাতে এক সমন্বিত ও কঠোর পদক্ষেপের অংশ। এর ফলে জাফলংয়ের ক্ষতবিক্ষত পরিবেশ আবার সেরে ওঠার সুযোগ পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বন্ধ হলো ৭৭টি পাথর ভাঙার যন্ত্র
কেন এই কঠোর পদক্ষেপ? উপদেষ্টাদের সেই সফর
এই অভিযানের পেছনে রয়েছে একটি উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত। গত ১৪ জুন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জাফলং পরিদর্শনে যান। এলাকার পরিবেশগত ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তারা দুটি যুগান্তকারী নির্দেশনা দেন:
১. ভবিষ্যতে কোনো ইজারা নয়: প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে জাফলংসহ সিলেটের কোনো পাথর কোয়ারি আর ইজারা দেওয়া হবে না।
২. অবৈধ যন্ত্রের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন: অবৈধভাবে পাথর ভাঙার কাজে ব্যবহৃত সকল ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ-সংযোগ দ্রুত বিচ্ছিন্ন করতে হবে। বন্ধ হলো ৭৭টি পাথর ভাঙার যন্ত্র
এই নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই ১৬ জুন থেকে স্থানীয় প্রশাসন অভিযানে নামে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত মোট ২৫৯টি পাথর ভাঙার যন্ত্রের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এই ধারাবাহিক অভিযান প্রমাণ করে, সরকার এবার জাফলংয়ের পরিবেশ রক্ষায় কতটা বদ্ধপরিকর।
জাফলংয়ের বুকে ক্ষত: একটি পরিবেশগত ধ্বংসযজ্ঞ
জাফলংকে সরকার ‘প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’ (Ecologically Critical Area – ECA) হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর অর্থ হলো, এখানকার জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য অত্যন্ত নাজুক। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নির্বিচারে পাথর উত্তোলনের ফলে এখানকার পরিবেশ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে।
- নদীর অপমৃত্যু: অবৈধভাবে পাথর তোলার ফলে পিয়াইন নদীর তলদেশ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে। এটি বর্ষাকালে আকস্মিক বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, যা জলবায়ু পরিবর্তন-এর এই যুগে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
- পাহাড় ও বৃক্ষ নিধন: পাথর উত্তোলনের জন্য কাটা হয়েছে অসংখ্য টিলা ও পাহাড়, ধ্বংস করা হয়েছে সবুজ বনাঞ্চল। এতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, বাড়ছে ভূমিধসের ঝুঁকি।
- মারাত্মক দূষণ: ক্রাশার মেশিনের বিকট শব্দ এবং উড়তে থাকা ধূলিকণা মারাত্মক শব্দ ও বায়ু দূষণ ঘটায়। এই ধুলা মানুষের শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি করার পাশাপাশি আশেপাশের গাছপালা ও ফসলের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
এক কথায়, টাকার লোভে জাফলংয়ের অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
রাজনীতির ছত্রছায়ায় অবৈধ ব্যবসা
প্রশ্ন হলো, ২০২০ সালে সরকার পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও কীভাবে এই ধ্বংসযজ্ঞ চলছিল? স্থানীয়দের মতে, এর পেছনে ছিল শক্তিশালী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা।
আগে একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা এই অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন। গত বছরের আগস্টে সরকারের পরিবর্তনের পর নিয়ন্ত্রণ নেন আরেকটি দলের স্থানীয় নেতারা। অর্থাৎ, ক্ষমতার পালাবদল হলেও জাফলংয়ের ভাগ্য বদলায়নি। রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই হাজারো শ্রমিককে দিয়ে অবৈধভাবে পাথর তুলে তা ক্রাশার মালিকদের কাছে বিক্রি করা হতো। এই অভিযান সেই পৃষ্ঠপোষকতার মূলে আঘাত হেনেছে।
শুধু বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করাই কি যথেষ্ট?
টাস্কফোর্সের এই অভিযান নিঃসন্দেহে একটি সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রতন কুমার অধিকারী জানিয়েছেন, পরিবেশবিধ্বংসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, শুধু বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাই কি এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান? অতীতে দেখা গেছে, অনেকেই জেনারেটরের মাধ্যমে রাতের আঁধারে মেশিন চালু রাখে। তাই এই অভিযানের পাশাপাশি প্রয়োজন সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং পাথর উত্তোলনের উৎসগুলো পুরোপুরি বন্ধ করা।
জাফলংয়ের কান্না থামাতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। উচ্ছেদকৃত স্থানে পুনরায় বনায়ন, ক্ষতিগ্রস্ত নদী ও পাহাড়কে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য পরিবেশবান্ধব বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করাই হবে আসল চ্যালেঞ্জ।
জাফলংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা করার এই উদ্যোগকে আপনি কীভাবে দেখছেন? পরিবেশ রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার গুরুত্ব কতটা বলে আপনি মনে করেন? আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের জানান।