সীতাকুণ্ডের উপকূলীয় আকাশে আজ হাতুড়ি আর এক্সকাভেটরের শব্দ। গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি আস্ত জাহাজভাঙা কারখানার কংক্রিটের কাঠামো। এটি কোনো সাধারণ উচ্ছেদ অভিযান নয়; এটি চট্টগ্রামের উপকূলীয় পরিবেশ এবং বনাঞ্চল রক্ষার এক দীর্ঘ ও রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের বিজয়ী মুহূর্ত। বনাঞ্চল কেটে, আদালতের নির্দেশ অমান্য করে এবং বারবার আইনি মারপ্যাঁচে টিকে থাকা ‘কোহিনূর স্টিল’ নামের সেই বিতর্কিত কারখানাটি অবশেষে উচ্ছেদ করেছে জেলা প্রশাসন। রাজা কাসেমের সাম্রাজ্য
এই ঘটনাটি শুধু একটি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পেছনে লুকিয়ে আছে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দাপট, আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে পরিবেশ ধ্বংসের এক ন্যক্কারজনক প্রচেষ্টা এবং তার বিরুদ্ধে পরিবেশকর্মী ও গণমাধ্যমের একাট্টা লড়াইয়ের এক জীবন্ত দলিল।
‘রাজা কাসেমের’ বারবার প্রত্যাবর্তন: এক কৌশলী ইজারার ইতিবৃত্ত
এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন আবুল কাসেম নামের এক ব্যবসায়ী, যিনি স্থানীয়ভাবে ‘রাজা কাসেম’ নামে পরিচিত। তার প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার সীতাকুণ্ডের তুলাতলী মৌজার সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখলের চেষ্টা করেছে।
- প্রথম প্রচেষ্টা (২০১৯): প্রথমে ‘বিবিসি স্টিল’ নামে তার একটি প্রতিষ্ঠানকে ৭.১ একর বনভূমি ইজারা দেয় তৎকালীন জেলা প্রশাসন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এই অবৈধ ইজারার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়।
- আদালতের রায় (২০২০): উচ্চ আদালত এই জমিকে বনাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি ইজারা চুক্তিটি অবৈধ ঘোষণা করেন।
- কৌশলী দ্বিতীয় প্রচেষ্টা (২০২২): ইজারা বাতিল হওয়ার পর ‘রাজা কাসেম’ নতুন কৌশল নেন। এবার তিনি তার স্ত্রী কোহিনূর আকতারের নামে ‘কোহিনূর স্টিল’ নামে একই জায়গায় ৫ একর বনভূমি ইজারার আবেদন করেন এবং তা পেয়েও যান। কাগজে-কলমে জমির অবস্থান দেখানো হয় পাশের সলিমপুর মৌজায়, কিন্তু বাস্তবে কারখানা গড়ে ওঠে তুলাতলী মৌজার বনাঞ্চলেই।
- গণমাধ্যমের ভূমিকা: এই জালিয়াতি নিয়ে ২০২২ এবং ২০২৩ সালে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা জনমত গঠনে এবং প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই ঘটনাপ্রবাহ দেখিয়ে দেয়, আইনকে পাশ কাটিয়ে প্রভাবশালী মহল কীভাবে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করতে পারে।
পরিবেশের বিনিময়ে শিল্প? একটি ধ্বংসযজ্ঞের খতিয়ান
এই জাহাজভাঙা কারখানাটি স্থাপনের জন্য প্রায় ৫ হাজার গাছসহ বিশাল একটি উপকূলীয় বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। এটি শুধু কিছু গাছ কেটে ফেলার ঘটনা নয়, এটি আমাদের পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার সক্ষমতার উপর এক বিরাট আঘাত।
- উপকূলীয় রক্ষাকবচ ধ্বংস: সীতাকুণ্ডের এই বনভূমি সমুদ্রের পাশে প্রাকৃতিক দেয়াল হিসেবে কাজ করে, যা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা কমিয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন-এর কারণে যখন দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়ছে, তখন এই ধরনের বন ধ্বংস করা আত্মহত্যার শামিল।
- দূষণের ঝুঁকি: জাহাজভাঙা শিল্প একটি মারাত্মক দূষণকারী শিল্প। পুরনো জাহাজের বিষাক্ত অ্যাসবেস্টস, ভারী ধাতু, তেল এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ মাটি ও পানিতে মিশে উপকূলীয় মৎস্যসম্পদ এবং সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দেয়।
চট্টগ্রাম বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিমের কথায় এই ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, “এই জাহাজভাঙা কারখানার কারণে আমাদের অনেক বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। এখন ইয়ার্ড উচ্ছেদ হয়েছে। আমরা আবার ওই জায়গায় বনাঞ্চল করব।” তার এই প্রতিশ্রুতি আমাদের আশার আলো দেখায়।
উচ্ছেদ অভিযান এবং আইনি লড়াইয়ের শেষ অধ্যায়
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আল আমিন হোসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভিযানে সেনা, র্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা অংশ নেন। পুরো এলাকা ঘিরে রেখে প্রায় ৩০ জন শ্রমিকের সহায়তায় দিনভর চলে উচ্ছেদ কার্যক্রম।
অভিযান চলাকালে কারখানার মালিক আবুল কাসেম দাবি করেন, তার স্থাপনা বৈধ এবং তিনি এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হবেন। তবে প্রশাসন জানায়, কারখানাটি যেখানে গড়ে উঠেছিল, সেটি জাহাজভাঙা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং এটি সরকারি খাসজমি ও বনাঞ্চল দখল করে তৈরি হয়েছিল, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে আদালতের চূড়ান্ত নির্দেশেই এই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়, যা পরিবেশ রক্ষায় বিচার বিভাগের দৃঢ় অবস্থানের একটি চমৎকার উদাহরণ।
শুধু একটি উচ্ছেদ নয়, একটি শক্তিশালী বার্তা
সীতাকুণ্ডের কোহিনূর স্টিল উচ্ছেদ শুধুমাত্র একটি অবৈধ কারখানা অপসারণ নয়। এটি দেশবাসীর জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা: পরিবেশ ধ্বংস করে, আইন অমান্য করে কেউ পার পাবে না, সে যত প্রভাবশালীই হোক না কেন। রাজা কাসেমের সাম্রাজ্য
এই বিজয় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং বিচার বিভাগ সোচ্চার থাকলে পরিবেশের বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেওয়া সম্ভব। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উচ্ছেদকৃত এই বিশাল এলাকাটিকে পুনরায় সবুজ বনে ফিরিয়ে আনা এবং যাতে কেউ সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করার দুঃসাহস না দেখায়, তা নিশ্চিত করা।
সীতাকুণ্ডের এই ঘটনা নিয়ে আপনার ভাবনা কী? প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পরিবেশ রক্ষার এই লড়াই কতটা কঠিন বলে আপনি মনে করেন? আপনার মতামত আমাদের জানান এবং এই বিজয় উদযাপনে শরিক হোন।