ঢাকা, ২৬ জুন ২০২৫: চারদিকে যখন বন উজাড়, দূষণ আর জলবায়ু পরিবর্তন-এর মতো দুঃসংবাদের ছড়াছড়ি, ঠিক তখনই পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরণ্য থেকে ভেসে এলো এক ঝলক আশার আলো। বন্য প্রাণী বিষয়ক সংস্থা ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (সিসিএ) তাদের ক্যামেরা ফাঁদে ধারণ করেছে এক রহস্যময় চিতা বাঘের ছবি। এই একটি ছবিই যেন সমগ্র দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতিপ্রেমীদের মধ্যে বইয়ে দিয়েছে আনন্দের বন্যা। স্বমহিমায় ঘুরে বেড়াচ্ছে চিতা বাঘ
কিন্তু এই আনন্দ কি নিছকই একটি দুর্লভ ছবি দেখার? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আমাদের ভঙ্গুর পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য নিয়ে আরও গভীর কোনো বার্তা? চলুন, এই রোমাঞ্চকর আবিষ্কারের গভীরে যাওয়া যাক।
ক্যামেরার চোখে এক ঝলক: যেভাবে মিলল দেখা
পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এক সংরক্ষিত বনে এই মাসের শুরুতে ছবিটি তোলা হয়। সিসিএ-এর গবেষকেরা বন্য প্রাণীর চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য প্রায় এক মাস আগে সেখানে ক্যামেরা ট্র্যাপ বা ফাঁদ স্থাপন করেন। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার সিজার নিশ্চিত করেছেন, ক্যামেরায় ধরা পড়া প্রাণীটি একটি পূর্ণবয়স্ক চিতা বাঘ (Leopard)। স্বমহিমায় ঘুরে বেড়াচ্ছে চিতা বাঘ
গবেষকরা বন্য প্রাণীর সুরক্ষার স্বার্থে এবং শিকারিদের হাত থেকে তাদের বাঁচানোর জন্য নির্দিষ্ট এলাকার নাম প্রকাশ করেননি। শাহরিয়ার সিজার বলেন, “আমরা ২০১৫ সালেও একবার চিতা বাঘের ছবি পেয়েছিলাম। এবারের ছবিটি আবারও প্রমাণ করলো যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে চিতা বাঘ এখনো টিকে আছে। তবে নিঃসন্দেহে বলা চলে, আগের মতো চিতা বাঘ এখন আর নেই।”
সিসিএ-এর ফেসবুক পেজে প্রকাশিত ছবিটিতে দেখা যায়, চিতা বাঘটি বনের মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই একটি দৃশ্যই যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সঠিক পরিবেশ পেলে প্রকৃতি আবারও তার আপন শক্তিতে জেগে উঠতে পারে।
শুধু একটি ছবি নয়, একটি সুস্থ পরিবেশের ইঙ্গিত
একটিমাত্র চিতা বাঘের ছবি কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, চিতা বাঘের মতো শীর্ষ শিকারিরা একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম বা পরিবেশ-এর নির্দেশক। প্রাণীবিদদের মতে, একটি বনে যদি চিতা বাঘ টিকে থাকতে পারে, তার মানে হলো:
- শিকারের প্রাচুর্য: সেই বনে চিতা বাঘের শিকার, যেমন—হরিণ, বুনো শূকর বা অন্যান্য ছোট প্রাণী পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান।
- বনের স্বাস্থ্য: শিকারি প্রাণীগুলো টিকে থাকার জন্য খাবারের প্রয়োজন, আর সেই খাবার আসে একটি সুস্থ বন থেকে। অর্থাৎ, বনটি ঘন এবং জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ।
এই সুস্থ বনভূমিই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। বন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে, মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং, চিতা বাঘের এই অস্তিত্ব প্রকারান্তরে একটি সুস্থ পরিবেশের প্রমাণ বহন করে, যা আমাদের সকলের জন্যই একটি দারুণ খবর।
অস্তিত্বের সংকট: শিকারি আর হারানো বসতি
তবে এই আনন্দের খবরের পেছনেই লুকিয়ে আছে এক কঠিন বাস্তবতা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান, বাঘবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম মনিরুল এইচ খান বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে চিতা আছে, এটা আবার প্রমাণিত হলো। বিষয়টা সত্যি সুখের। তবে শিকারিদের দৌরাত্ম্যও কম নয়, যার কারণে সহজে তাদের দেখা যায় না।” স্বমহিমায় ঘুরে বেড়াচ্ছে চিতা বাঘ
বিশেষজ্ঞরা উভয়েই একমত যে, শিকার এবং বাসভূমি ধ্বংসই এই চমৎকার প্রাণীটির অস্তিত্বের প্রধান হুমকি। বন উজাড় হওয়ার ফলে তাদের বিচরণক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে। খাবারের সন্ধানে অনেক সময় তারা লোকালয়ের কাছাকাছি চলে আসে, যা মানুষ ও বন্য প্রাণীর মধ্যে সংঘাত তৈরি করে। জলবায়ু পরিবর্তন-এর ফলে আবহাওয়ার ধরণ বদলে যাওয়াও পরোক্ষভাবে তাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে।
ইতিহাসের পাতা থেকে: শত বছর আগেও ছিল তাদের বিচরণ
পার্বত্য চট্টগ্রামে চিতা বাঘের অস্তিত্ব নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ প্রশাসক আর এইচ স্নেইড হাচিনসনের লেখা ‘অ্যান অ্যাকাউন্ট অব দ্য চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস’ বই থেকে জানা যায়, ১৮৯০ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যেও সাঙ্গু ও মাতামুহুরী অববাহিকার বনে এই চিতা বাঘের অবাধ বিচরণ ছিল।
ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই বনভূমি একসময় ছিল জীববৈচিত্র্যের এক বিশাল ভান্ডার। শত বছরের ব্যবধানে আমরা সেই ভান্ডারের অনেকটাই হারিয়েছি। এখন যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা রক্ষা করাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংরক্ষণই একমাত্র পথ
পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে একটি চিতা বাঘের ছবি শুধু একটি রোমাঞ্চকর আবিষ্কার নয়, এটি আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তাও বটে। এটি আমাদের বলছে, এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। সঠিক পদক্ষেপ নিলে আমরা আমাদের অমূল্য বন ও বন্য প্রাণীদের রক্ষা করতে পারি।
অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানের মতে, যে এলাকায় চিতা বাঘের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে, সেই অঞ্চলকে কঠোরভাবে সংরক্ষণ করতে হবে এবং শিকারিদের দৌরাত্ম্য শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।
এই লড়াই শুধু বন বিভাগ বা গবেষকদের নয়। এই লড়াই আমাদের সবার। এই চিতা বাঘটিকে বাঁচানোর অর্থ হলো আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের অমূল্য পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যকে বাঁচানো। আর এই পরিবেশকে বাঁচানোর অর্থ হলো জলবায়ু পরিবর্তন-এর ভয়াবহ প্রভাব থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই বাঘটিকে রক্ষা করার জন্য আমাদের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? বন্য প্রাণী এবং পরিবেশ রক্ষায় আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগের কথা আমাদের জানান। আসুন, আলোচনা করি এবং সচেতনতা বাড়াই।