জলবায়ু পরিবর্তন এখন শুধু একটি বৈজ্ঞানিক আলোচনা নয়, এটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এক অমোচনীয় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বে নানা ধরনের বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণকে ‘নেট জিরো’ এ নামিয়ে আনা না গেলে এই প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। জাতিসংঘের মতে, এই লক্ষ্য অর্জনে সরকার, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।
নেট জিরো বলতে কী বোঝায়?
নেট জিরো মানে হলো যতটা কার্বন নির্গত হচ্ছে, ততটাই বায়ুমণ্ডল থেকে অপসারণ করা। এটি নিঃসরণ পুরোপুরি বন্ধের কথা নয়, বরং যে পরিমাণ কার্বন বাতাসে যুক্ত হচ্ছে, তা সমান পরিমাণে অপসারণ করা। আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা এখনো অনেক বেশি, তাই এই নির্গমনের পরিমাণ কমানো এবং গ্রিনহাউস গ্যাস অপসারণের কার্যকর উপায় বের করা অপরিহার্য। গাছ লাগানো, বনাঞ্চল পুনরুদ্ধার এবং কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে এ লক্ষ্যে।
গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রধান উৎস
কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) এবং মিথেন (CH4) হলো দুটি প্রধান গ্রিনহাউস গ্যাস। CO2 প্রধানত তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত হয়, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পকারখানা এবং যানবাহনে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, মিথেন নির্গত হয় কৃষিকাজ, পশুপালন এবং ল্যান্ডফিল থেকে। এই গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলে তাপ ধরে রাখে এবং পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বরফের পাহাড় গলে যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং চরম আবহাওয়া সম্পর্কিত দুর্যোগের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। দ্রুত বন নিধন এবং বনাঞ্চলের সংকোচনের ফলে CO2 অপসারণের হারও হ্রাস পাচ্ছে, যা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে।
নেট জিরো অর্জনের উপায়
নেট জিরো অর্জনের অর্থ সব ধরনের কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করা নয়। কিছু নির্গমন অবশিষ্ট থাকবে, যা অপসারণের জন্য আমাদের প্রকৃতি ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন, গাছ লাগিয়ে প্রাকৃতিকভাবে CO2 অপসারণ করা যায়, আর প্রযুক্তিগতভাবে কার্বন ক্যাপচার যন্ত্র ব্যবহার করে সরাসরি বায়ু থেকে CO2 সংগ্রহ করা সম্ভব। তবে, এই প্রযুক্তিগুলো এখনো ব্যয়বহুল এবং সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন।
কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হয়, যেখানে নির্গত CO2 মাটির নিচে সংরক্ষণ করা হয়। যদিও এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তবে এখনো এটি মোট কার্বন নির্গমনের খুব ছোট একটি অংশ অপসারণ করতে পারে। তাই, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো ছাড়া এই প্রযুক্তি যথেষ্ট কার্যকর হবে না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পদক্ষেপ
বিশ্বের প্রায় ১৪৫টি দেশ নেট জিরো লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যা বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের প্রায় ৯০ শতাংশকে কভার করে। চীন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় CO2 নির্গমনকারী দেশ, ২০৬০ সালের মধ্যে ‘কার্বন নিরপেক্ষতা’ অর্জনের পরিকল্পনা করেছে। যদিও চীনের পরিকল্পনা পুরোপুরি বিকশিত হয়নি, তবে তাদের নবায়নযোগ্য শক্তি ও বৈদ্যুতিক যানবাহনের বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইতিহাসের অন্যতম বড় কার্বন নির্গমনকারী দেশ, ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরো অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’ নামে একটি বিশাল বিনিয়োগ প্যাকেজ চালু করেছে, যা নবায়নযোগ্য শক্তি ও সবুজ প্রযুক্তির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরো অর্জনের জন্য ‘নেট জিরো ইন্ডাস্ট্রি অ্যাক্ট’ চালু করেছে।
নেট জিরো লক্ষ্যের চ্যালেঞ্জ
নেট জিরো লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক রয়েছে। কিছু দেশ তাদের নির্গমনের হিসাব কম দেখানোর জন্য এমন কৌশল ব্যবহার করে, যাতে কার্বন নির্গমন কৃত্রিমভাবে কম মনে হয়। যেমন, অন্য দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে নিজের দেশে নির্গমন কম দেখানো। এছাড়া, কিছু প্রতিষ্ঠান নির্গমন ‘অফসেট’ করার নামে গাছ লাগানো বা অন্য উদ্যোগে অর্থ প্রদান করে, যা সবসময় কার্যকর নয় এবং একে ‘গ্রিনওয়াশিং’ হিসেবেও সমালোচনা করা হয়।
কিছু বিজ্ঞানীর মতে, ২০৫০ সালের লক্ষ্য নিয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া বর্তমান সময়ে প্রয়োজনীয় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি ভুলিয়ে দিতে পারে। বিশ্ব এখনও জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষ্যের জন্য সঠিক পথে নেই।
উপসংহার
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নেট জিরো অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এর জন্য আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সরকার, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষ একসঙ্গে কাজ করলে এই সংকটের সমাধান সম্ভব। এখনই দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ ও টেকসই সমাধান গ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতন হোন, টেকসই জীবনধারা গ্রহণ করুন এবং পরিবেশ রক্ষায় আপনার ভূমিকা পালন করুন।