কপ২৯: ৩০০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন কি যথেষ্ট? বিশ্লেষণ বলছে ভিন্ন কথা!
ভূমিকা
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে শেষ হলো কপ২৯, জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন। এই সম্মেলন ঘিরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক আশা থাকলেও শেষ পর্যন্ত চুক্তি তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ধনী দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নে সম্মত হয়েছে। যদিও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি ছিল এর চেয়ে অনেক বেশি—বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর। অথচ এই সংকটের জন্য মূলত দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ। এবারের কপ সম্মেলনে এই বাস্তবতা মেনে কিছু সমাধানের চেষ্টা করা হলেও, তা অনেকটাই প্রতীকি পর্যায়ে রয়ে গেছে।
ধনী ও দরিদ্র দেশের বিরোধ: কেন সমঝোতা কঠিন?
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোর দাবি ছিল বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এই অর্থ দিয়ে তারা তাদের অর্থনীতিকে আরও পরিবেশবান্ধব করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চেয়েছিল।
অন্যদিকে, ধনী দেশগুলো বরাদ্দ বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনীহা দেখায় এবং প্রতি বছর ৩০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। দরিদ্র দেশগুলো এটিকে অপ্রতুল বলে উল্লেখ করে এবং সম্মেলন একদিন বাড়ানোর পর শেষ মুহূর্তে এই বরাদ্দে সম্মত হয়।
ধনী দেশগুলোর এই সীমিত প্রতিশ্রুতির পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর অনেক সরকার প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণে আগ্রহ হারাচ্ছে। বিশেষ করে ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের কারণে জলবায়ু অর্থায়নে সেগুলোর আগের প্রতিশ্রুতি কমে গেছে।
চুক্তির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক
চুক্তি অনুযায়ী, ২০৩৫ সাল পর্যন্ত দরিদ্র দেশগুলোর জন্য প্রতি বছর ৩০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ থাকবে। এই অর্থ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো দুর্যোগ মোকাবিলা, সবুজ অবকাঠামো উন্নয়ন, এবং নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে।
তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো মনে করে, এই অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পাওয়ার শিফট আফ্রিকার পরিচালক মোহামেদ আদোউ বলেছেন, “ধনী দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই চুক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য একটি বড় বিপর্যয়।”
অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি ওপকে হোয়েকস্ট্রা এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “এটি জলবায়ু অর্থায়নের নতুন যুগের সূচনা।”
প্যারিস চুক্তি: প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা কত দূর?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ ৪৩ শতাংশ কমানো। কিন্তু কপ২৯-এর আলোচনায় এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
ধনী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমানোর দায়িত্ব কাঁধে নিতে প্রস্তুত নয়। তারা নিজেদের আর্থিক ও রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরছে এবং তহবিল বরাদ্দের দায় অন্য দেশের ওপর চাপাচ্ছে। এর ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্য ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপ্রবণ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। উপকূলীয় এলাকা, নদীভাঙন, এবং খরার মতো দুর্যোগ এই সংকটের কারণে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। কপ২৯ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য কিছু শিক্ষা রেখে গেছে, যা ভবিষ্যতে কাজে লাগানো যেতে পারে।
১. দক্ষ প্রকল্প পরিকল্পনা
বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রকল্প তৈরির দক্ষতা বাড়াতে হবে। শুধু দাবি জানানো নয়, বরং সুনির্দিষ্ট, বৈজ্ঞানিক এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা উপস্থাপন করে বৈশ্বিক তহবিল আকর্ষণ করতে হবে।
২. স্থানীয় উদ্ভাবন ও উদ্যোগ
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় উদ্যোগকে গুরুত্ব দিতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি, সবুজ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উপকূলীয় পুনর্বাসনে বিনিয়োগ বাংলাদেশকে টেকসই সমাধানের পথে এগিয়ে নিতে পারে।
৩. আন্তর্জাতিক কূটনীতি
বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও সক্রিয় হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জোটে নেতৃত্ব দেওয়া এবং ধনী দেশগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ।
৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় জনসচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রতিটি স্তরে পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
সমাপ্তি: জলবায়ু সংকটের ভবিষ্যৎ সমাধান
কপ২৯-এর ফলাফল হতাশাজনক হলেও এটি জলবায়ু অর্থায়নের পথে একটি পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং ধনী দেশগুলোর ওপর আরও চাপ প্রয়োগ করলে এই চুক্তি আরও কার্যকর হতে পারে।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কেবল অর্থায়নের অপেক্ষায় না থেকে নিজেদের দক্ষতা ও কৌশল দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোগগুলোকে শক্তিশালী করতে পারলেই জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই সম্ভব।
আপনার মতামত দিন: কপ২৯-এর চুক্তি নিয়ে আপনার ধারণা কী? পরিবেশ রক্ষায় আপনার ভূমিকা কী হতে পারে? নিচে মন্তব্য করে জানান এবং সচেতনতা বাড়াতে পোস্টটি শেয়ার করুন।