জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯: বিশ্বকে হতাশায় ফেললো ‘ফাইন্যান্স কপ’!
ভূমিকা
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পৃথিবীর দেশগুলো আবারও একত্র হয়েছিল বাকুতে অনুষ্ঠিত কপ২৯ সম্মেলনে। ‘ফাইন্যান্স কপ’ নামে পরিচিত এই সম্মেলন থেকে প্রত্যাশা ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থায়নের একটি নির্দিষ্ট ও কার্যকর কাঠামো। কিন্তু দুই সপ্তাহের তুমুল আলোচনার পরও কাঙ্ক্ষিত সমাধান মেলেনি। জলবায়ু বিপন্ন দেশগুলো হতাশ, আর বিশ্বজুড়ে পরিবেশকর্মীরা একে ‘অসম্পূর্ণ ও অপ্রতুল’ বলছেন। তহবিল নিয়ে বড় লড়াই
তহবিলের টানাপোড়েন: উন্নয়নশীল বনাম শিল্পোন্নত দেশ
উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির জন্য বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার দাবি করেছে। অন্যদিকে, শিল্পোন্নত দেশগুলো সর্বোচ্চ ৩০০ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিয়েছে, তাও শর্তসাপেক্ষ। চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এই তহবিলে অর্থ জমা দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি এলডিসি দেশ এই প্রস্তাবে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “এ ধরনের তহবিল প্রকৃত সমস্যার সমাধান নয়। এটি প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল এবং কোনো নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যেও নেই।”
বিশ্ব রাজনীতির প্রভাব: ডানপন্থীদের উত্থানে সংকট
কপ২৯-এর আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো শিল্পোন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিবর্তন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরুত্থান এবং অন্যান্য ডানপন্থী নেতাদের জনপ্রিয়তা জলবায়ু চুক্তির জন্য বড় বাধা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু তহবিল ও কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
কার্বন নিঃসরণ কমানোর চ্যালেঞ্জ
বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৪৩ শতাংশ কমানো না গেলে এই শতাব্দীর মধ্যে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে পারে। অথচ বিশ্বের প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
কপ২৯ সম্মেলন বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে গেছে। জলবায়ু তহবিল থেকে পর্যাপ্ত অর্থ পেতে হলে কেবল দাবি জানানো যথেষ্ট নয়; বরং কার্যকর প্রক্রিয়া এবং সক্ষমতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের স্থান দৃঢ় করতে হবে। তহবিল নিয়ে বড় লড়াই
১. দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি
জলবায়ু তহবিলের অর্থ পেতে হলে প্রথমত প্রকল্প তৈরির দক্ষতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে এমন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং নির্দিষ্ট সমস্যার কার্যকর সমাধান দিতে সক্ষম। পাশাপাশি, প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত ব্যবস্থাপনা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সমন্বয় ছাড়া বৈশ্বিক তহবিল থেকে পর্যাপ্ত অর্থায়ন সম্ভব নয়।
২. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোচ্চার ভূমিকা
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর দাবিগুলোকে আরও জোরালো করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোটবদ্ধ হওয়া এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করা অপরিহার্য।
বাংলাদেশকে কপ সম্মেলনগুলোর প্রতিটি পর্যায়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কেবল বক্তৃতা বা প্রতিবাদ নয়, বরং বৈজ্ঞানিক তথ্য ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ উপস্থাপনের মাধ্যমে তহবিলের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে হবে।
৩. স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোগ বৃদ্ধি
আন্তর্জাতিক তহবিলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বসে থাকা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশকে স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। এতে কেবল পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং অর্থনৈতিক সঙ্কট সমাধানের দিকেও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
৪. শিক্ষা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে দেশের জনগণকে সচেতন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ ও শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষামূলক কর্মসূচি আয়োজন করে প্রকৃত সমস্যা এবং এর সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যেতে পারে।
সমাপ্তি: আশার আলো কি মিলবে?
কপ২৯-এর ফলাফল দেখে হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যে ধরনের তহবিল প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কথা ছিল, তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এখানেই থেমে থাকার সুযোগ নেই।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং জোটবদ্ধ আন্দোলন ভবিষ্যতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। আন্তর্জাতিক চাপ এবং স্থানীয় উদ্যোগের সমন্বয়ে বাংলাদেশও তার প্রয়োজনীয় তহবিল এবং সহযোগিতা পেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই চলমান রাখতে হলে কপ সম্মেলনকে কেবল আলোচনা ও নথি বিনিময়ের প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং কার্যকর সমাধানের ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করা সম্ভব।
পরিবেশ রক্ষায় আমাদের ভূমিকা কী হতে পারে? আপনার মতামত শেয়ার করুন। সচেতনতা বাড়াতে পোস্টটি শেয়ার করুন।