উচ্চতা হারাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বত মাউন্ট এভারেস্ট!
বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এভারেস্ট ধীরে ধীরে উচ্চতা হারাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত কয়েক দশকে প্রায় ১৫০ ফিট উচ্চতা হারিয়েছে এই পর্বতটি। ২০২৩ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছে, যা পর্বতের ক্রমাগত উচ্চতা হ্রাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এভারেস্টের উচ্চতা কমছে
এভারেস্টের ভৌগোলিক পরিচিতি
মাউন্ট এভারেস্ট স্থানীয়ভাবে সাগরমাথা (নেপাল) বা কোমোলাংমা (চীন) নামে পরিচিত। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত এবং হিমালয়ের মহালাঙ্গুর হিমাল উপ-রেঞ্জে অবস্থিত। চীন-নেপাল সীমান্ত বরাবর এর সামিট পয়েন্ট অবস্থিত। ২০২০ সালে চীন ও নেপালের যৌথ গবেষণায় এভারেস্টের উচ্চতা পুনরায় মেপে ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং তুষারপাতের হ্রাসের ফলে এভারেস্ট তার উচ্চতা হারাচ্ছে।
কেন কমছে এভারেস্টের উচ্চতা?
১. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
পরিবেশবিদদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তুষারপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। নিকোলস কলেজের পরিবেশ বিজ্ঞানী ও হিমবাহবিদ মাউরি পেল্টো জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তুষারপাতের হার কিছুটা বেড়েছে, তবে তা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ২০২১, ২০২৩, ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে শীতকাল যথেষ্ট শীতল ছিল না, বরং উষ্ণতার কারণে বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। এভারেস্টের উচ্চতা কমছে
২. হিমবাহ গলে যাওয়া
এভারেস্টের উচ্চতা নির্ভর করে এর উপরের স্তরের বরফ ও হিমবাহের ওপর। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে হিমবাহের গলন প্রক্রিয়া দ্রুততর হচ্ছে, যার ফলে বরফের স্তর পাতলা হয়ে পড়ছে এবং এর উচ্চতা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর গড়ে ০.৩ মিটার থেকে ০.৫ মিটার পর্যন্ত বরফ গলে যাচ্ছে।
৩. ভূমিকম্প ও ভৌগোলিক পরিবর্তন
এভারেস্ট অবস্থিত ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে। ২০১৫ সালে নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে এভারেস্টের উচ্চতা প্রায় ২.৫ সেন্টিমিটার কমে গিয়েছিল। এই ধরনের ভূমিকম্প পর্বতের কাঠামো পরিবর্তন করতে পারে এবং উচ্চতা কমানোর একটি বড় কারণ হতে পারে।
ভবিষ্যৎ কী?
মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা হ্রাসের বর্তমান প্রবণতা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের বিঘ্নিত হওয়া শুধু এভারেস্টকেই নয়, হিমালয়ের অন্যান্য পর্বতশৃঙ্গ, গ্লেসিয়ার এবং পুরো অঞ্চলের পরিবেশকেও বিপর্যস্ত করে তুলছে। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশকে হিমালয়ের বরফ আরও দ্রুত গলতে শুরু করবে, যা একাধিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
১. বরফ গলার গতি আরও বাড়বে
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে হিমালয়ের বরফ স্তর ক্রমশ পাতলা হয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত দুই দশকে এভারেস্টের বরফ প্রায় ৫৫ মিটার (১৮০ ফুট) পাতলা হয়েছে। ভবিষ্যতে উষ্ণতা বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে, বরফ গলার হার আরও ত্বরান্বিত হবে, যা এভারেস্টের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে।
২. হিমবাহ সংকট ও পানির উৎস হ্রাস
এভারেস্টসহ হিমালয়ের হিমবাহগুলি এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পানির উৎস। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, ইয়াংসি এবং মেকং নদীসহ বেশ কয়েকটি প্রধান নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয়ে। যদি হিমবাহগুলি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে, তাহলে এই নদীগুলোর পানির প্রবাহ কমে যাবে, যা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের জন্য মারাত্মক পানি সংকট তৈরি করবে।
৩. পর্বতারোহীদের জন্য ঝুঁকি বৃদ্ধি
এভারেস্টে পর্বতারোহণ ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। উচ্চতা হ্রাস মানেই পর্বতটির শীর্ষ বরফ স্তর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, ফলে আরোহণের সময় তুষারধস ও পাথর ধসের ঝুঁকি বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্রমাগত বরফ গলার ফলে এভারেস্টের বেস ক্যাম্প পর্যন্ত সরতে হতে পারে, কারণ মাটি ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।
৪. স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য বিপর্যয়
নেপাল ও তিব্বতের স্থানীয় শেরপা জনগোষ্ঠী এবং অন্যান্য পাহাড়ি সম্প্রদায় সরাসরি এভারেস্ট ও হিমালয়ের পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। তুষারপাত কমে যাওয়া এবং হিমবাহ সংকোচনের ফলে তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠছে। কৃষিকাজ, গবাদি পশুর চারণভূমি, এবং পর্যটন শিল্প—সবই প্রভাবিত হচ্ছে।
৫. ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ও সম্ভাব্য সমাধান
পরিবেশবিদরা বলছেন, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সম্ভাব্য সমাধানের মধ্যে রয়েছে:
- কার্বন নির্গমন কমানো: বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো জরুরি।
- পর্বত সংরক্ষণ পরিকল্পনা: নেপাল এবং চীনের সরকারকে অবশ্যই কঠোর পরিবেশগত নীতি গ্রহণ করতে হবে, বিশেষ করে এভারেস্ট অঞ্চলে পর্যটনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে।
- গবেষণা ও নজরদারি বৃদ্ধি: আরও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে এভারেস্ট ও হিমালয়ের পরিবেশগত পরিবর্তন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা দরকার, যাতে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
- স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা: পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শেরপা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস তৈরি করা এবং তাদের জলবায়ু সহনশীল করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
শেষ কথা
মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা হ্রাস শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক পরিবর্তন নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। এ কারণে আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণে আরও গুরুত্ব দিতে হবে এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিং রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না! জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে এই পোস্টটি শেয়ার করুন এবং আমাদের কমেন্ট সেকশনে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।