25.4 C
Bangladesh
শুক্রবার, মে ৩০, ২০২৫
spot_img

দিনে আগুনের মতো গরম, রাতে শীতের কুয়াশা- জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন সংকেত?

ভিন্ন আবহাওয়ার চিত্র: দিন-রাতের বিপরীত রূপ

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক অদ্ভুত আবহাওয়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে। দিনে প্রচণ্ড গরম, আর রাতে হঠাৎ ঠান্ডা অনুভব হয়। বিশেষ করে দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে বা কিছু হাওর এলাকায় রাতে গায়ে চাদর কিংবা কাঁথা নিতে হচ্ছে। ভোরের দিকে চারদিক ঢেকে যায় কুয়াশার মতো ধোঁয়াশায়। অথচ দুপুর গড়াতে না গড়াতেই সেই ধোঁয়াশা উধাও হয়ে যায়, এবং সূর্যের প্রচণ্ড তাপে চারপাশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দিনে আগুনের মতো গরম

অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। অনেকের মনে প্রশ্ন, দিনে এত গরম আর রাতে হঠাৎ ঠান্ডা, এমন বৈপরীত্য কেন? এটা কি পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত?

আবহাওয়ার এই বৈপরীত্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

আবহাওয়াবিদদের মতে, এই সময়টা হলো প্রাক-মৌসুমি বায়ুর সময়। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই সময়ে সূর্য বাংলাদেশ অঞ্চলের অনেক কাছাকাছি অবস্থান করে। দিনভর খোলামেলা আকাশ আর সূর্যের উলম্ব কিরণে ভূপৃষ্ঠ প্রচণ্ড গরম হয়ে ওঠে। এই গরম দিনে বজায় থাকলেও সূর্য অস্ত যাওয়ার পর তার তাপ ধীরে ধীরে বিকিরণ হয়ে আবার পরিবেশে ফিরে যায়। ফলে রাতের বেলা আকাশ পরিষ্কার থাকলে এবং মেঘ কম থাকলে, এই বিকিরণের ফলে ভূপৃষ্ঠ ঠান্ডা হতে শুরু করে। রাত যত বাড়তে থাকে, এই শীতলতাও তত গভীর হয়।

এর সঙ্গে যুক্ত হয় ধুলো, বালু, ও দূষিত বাতাসের প্রভাব। বৃষ্টি কম থাকার ফলে বাতাসে ধুলোবালি বেশি থাকে। রাতের শীতল আবহাওয়ায় বাতাসের জলীয় বাষ্প ও ক্ষুদ্র কণাগুলো মিলিত হয়ে এক ধরণের পর্দা তৈরি করে, যেটা অনেকটা কুয়াশার মতো দেখা যায়। যদিও technically এটাকে কুয়াশা বলা ঠিক না, বরং একে বলা যায় ধোঁয়াশা বা হেজ। ভোরের দিকে এই পর্দা সবচেয়ে ঘন হয় এবং সূর্য উঠতে থাকলে তা দ্রুতই মিলিয়ে যায়। দিনে আগুনের মতো গরম

দিনে তাপমাত্রা বাড়ছে, রাতে কমে যাচ্ছে কেন?

প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী, দিনে সূর্যের তাপে মাটি ও আশেপাশের পরিবেশ গরম হয়ে যায়। বিশেষ করে যেসব এলাকায় গাছপালা কম, মাঠঘাট উন্মুক্ত এবং মেঘ নেই, সেসব জায়গায় এই গরম আরও বেশি অনুভূত হয়। তবে রাতের বেলায় যখন সূর্য থাকে না, তখন আকাশ পরিষ্কার থাকলে সেই তাপ সহজেই বিকিরণ হয়ে যায়। ফলে দিনে ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকলেও রাতে তা নেমে যেতে পারে ১৭-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি।

উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এলাকায় বিশেষ করে এ ধরনের পার্থক্য বেশি দেখা যায়। কারণ এসব এলাকায় খোলা জায়গা বেশি, জলাভূমি বা হাওর রয়েছে, যেখানে জলীয় বাষ্প রাতের শীতে আরও ঠান্ডা হয়ে যায়। আবার শহর এলাকায় যেমন ঢাকা বা চট্টগ্রামে এই পার্থক্য কম, কারণ এসব জায়গায় দালানকোঠা, যানবাহন, এবং মানুষের চলাচল বেশি থাকায় পরিবেশের তাপ দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখে।

ধোঁয়াশার কারণ ও উৎস

এ সময়ে ভারতের দিল্লি, পাকিস্তানের লাহোর হয়ে আন্তমহাদেশীয় দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে। উত্তরের দিনাজপুর, রংপুর অঞ্চল দিয়ে এই দূষিত বাতাস বাংলাদেশে ঢুকে পরে। এর ফলে যেসব জায়গা বেশি উন্মুক্ত, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল বা হাওর অঞ্চল, সেখানে এই ধোঁয়াশার প্রভাব বেশি দেখা যায়। বৃষ্টির অভাব, ধুলোবালি, এবং বাতাসে জলীয় বাষ্প মিলে এই ধোঁয়াশা ঘন হয়ে ওঠে।

আরও একটি বিষয় এখানে কাজ করে, যেটা হচ্ছে বাউন্ডারি লেয়ার হাইট (Boundary Layer Height – BLH)। দিনের বেলা সূর্যের তাপে BLH গভীর থাকে, ফলে দূষিত বায়ু বা ধোঁয়াশা ওপরের দিকে চলে যায়। কিন্তু রাতের ঠান্ডায় এই স্তর কমে আসে, ফলে ধোঁয়াশা বা দূষিত কণা নিচের দিকে ঘনীভূত হয়ে থাকে। তাই ভোরের দিকে ধোঁয়াশা বেশি দেখা যায়।

ঢাকায় এ ধরনের অবস্থার প্রভাব কম কেন?

রাজধানীর মতো শহর এলাকায় এই পার্থক্য তুলনামূলকভাবে কম। কারণ শহরে বড় বিল্ডিং, রাস্তা, কম গাছপালা, যানবাহনের তাপ এবং জনবহুলতার কারণে রাতের তাপমাত্রা খুব একটা কমে না। ফলে দিনের গরম এবং রাতের ঠান্ডার মধ্যে পার্থক্য শহর অঞ্চলে কম অনুভূত হয়। দিনে আগুনের মতো গরম

পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ইঙ্গিত

দিনে গরম, রাতে কোথাও ঠান্ডা ও কুয়াশার মতো অবস্থা নতুন কিছু নয়। তবে, এর প্রকোপ ও বিস্তার কিছুটা বাড়ছে। এর পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, শহরায়ন, বনভূমি ধ্বংস, এবং বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়া। জলবায়ুর এই পরিবর্তন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ক্রমেই বড় প্রভাব ফেলছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব পরিবর্তনের কারণে কৃষি, জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। অতিরিক্ত গরম, রাতে হঠাৎ ঠান্ডা, ধোঁয়াশা, এবং তাপমাত্রার ওঠানামা — সবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিফলন।

শেষ কথা

দিনে গরম, রাতে কোথাও ঠান্ডা ও কুয়াশার মতো — এই অদ্ভুত আবহাওয়া পরিস্থিতি আমাদের পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের স্পষ্ট চিহ্ন। এর কারণ বুঝে, সচেতনতা তৈরি করা জরুরি। পরিবেশ রক্ষা, গাছ লাগানো, এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া এই পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হতে পারে।

আপনার এলাকায় দিনে গরম আর রাতে ঠান্ডা পরিস্থিতি কেমন? ভোরের ধোঁয়াশা আপনাকে কতটা বিস্মিত করছে? মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না। আবহাওয়ার এই পরিবর্তন সম্পর্কে জানুন, সতর্ক থাকুন, এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হোন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ