25.4 C
Bangladesh
শুক্রবার, মে ৩০, ২০২৫
spot_img

বান্দরবানে বন উজাড়: হাতি দিয়ে গাছ পাচারের অন্ধকার দুনিয়া

বাংলাদেশের বান্দরবান জেলা, বিশেষ করে টঙ্কাবতী এলাকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বর্তমানে এক বিপদের সম্মুখীন। এখানে বন উজাড় করার এক অদ্ভুত কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে—হাতি দিয়ে গাছ টেনে পাচার করা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কিছু কাঠ ব্যবসায়ী পাহাড়ের দুর্গম এলাকা থেকে বনাঞ্চলের গাছ কেটে হাতির সাহায্যে সেগুলো দূরে নিয়ে আসছে এবং সেগুলোর পাচার চলছে। এই প্রক্রিয়া শুধু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়, এলাকার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও বিরাট প্রভাব ফেলছে। চলুন, এই ঘটনা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানি। বান্দরবানে বন উজাড়

হাতি দিয়ে কাঠ পাচারের পদ্ধতি:

এলাকার লোকজন জানান, বনাঞ্চল থেকে গাছ কাটা ও পাচার করার জন্য কাঠ ব্যবসায়ীরা হাতি ব্যবহার করেন। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যানবাহন প্রবেশের উপযোগী রাস্তাগুলোর অভাবের কারণে হাতি ব্যবহার করা হয়। হাতিগুলোর সাহায্যে, শ্রমিকরা বনাঞ্চল থেকে গাছগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে আসেন। এরপর ট্রাকে করে সেগুলোর পাচার করা হয়। এই পাচারের পুরো প্রক্রিয়া দিনের পর দিন চলে, কিন্তু প্রশাসনের নজর এড়িয়ে চলে যায়।

বন উজাড়কারী এই কৌশল অনেকটাই অবৈধ হলেও স্থানীয় প্রশাসন এখনও এর বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এমনকি, এই পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা জানান, তারা এই গাছগুলো কাটতে কাজ করছেন কিন্তু এর প্রকৃত মালিকরা সম্পূর্ণ গোপনে এই কাজটি চালাচ্ছে। বান্দরবানে বন উজাড়

যে গাছগুলো কাটা হচ্ছে:

এই পাচারের জন্য যেসব গাছ কাটা হচ্ছে তা মূলত বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক গাছ, যেমন—কড়ই, শিউরি, গুটগুট্যা, ইত্যাদি। কাঠ ব্যবসায়ীরা জানান, এসব গাছ তারা হাতির সাহায্যে পাহাড়ের নির্জন অঞ্চলে নিয়ে আসেন এবং সেগুলো ট্রাকে লোড করে পাচার করেন। এই কাজটি তিন মাস ধরে চলমান, এবং তার ফলে পরিবেশের উপর ইতোমধ্যে বিরাট প্রভাব পড়েছে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং সামাজিক প্রভাব:

বন উজাড়ের প্রক্রিয়া শুধু পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক নয়, এটি মানুষের জীবনযাত্রাকেও প্রভাবিত করছে। চিম্বুক পাহাড়ের আশেপাশে বাস করা ম্রো সম্প্রদায়ের জন্য এই বনাঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, বন উজাড়ের ফলে পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে। তাদের পানির অভাব সৃষ্টি হচ্ছে, যার ফলে জীবনযাত্রা চরম সংকটে পড়ছে। পানি সংকট তাদের কৃষিকাজ এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলছে।

এছাড়াও, বনের গাছ কাটার ফলে বন্যপ্রাণীর বাসস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ইকোসিস্টেমের ভারসাম্যকে বিপন্ন করবে।

জোত পারমিটের অপব্যবহার:

এই বন উজাড়ের মূল কারণ একধরনের সরকারি অনুমোদন, যা ‘জোত পারমিট’ নামে পরিচিত। এই পারমিটটি মূলত কৃষি বাগানে গাছ কাটা ও পরিবহন করার জন্য দেওয়া হয়, কিন্তু কিছু কাঠ ব্যবসায়ী এই পারমিটের অপব্যবহার করে বনাঞ্চলের গাছ কেটে পাচার করছে। পারমিট অনুযায়ী, ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে রোপিত গাছ কাটা ও পরিবহন করা অনুমোদিত, কিন্তু বনাঞ্চলের গাছ কাটা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু এই অপব্যবহার পুরোপুরি চালু রয়েছে এবং তাতে প্রশাসনিক অবহেলা রয়েছে।

অভিযোগ এবং প্রশাসনের ভূমিকা:

স্থানীয় কাঠশ্রমিক মো. বেলাল ও জসীম জানিয়েছেন, তারা লোহাগড়া উপজেলার আবদুর রহিমের হয়ে গাছ কাটছেন। কিন্তু এই অভিযুক্ত ব্যক্তি জানালেন, তিনি কেবল বাগান থেকে গাছ কাটার জন্য পারমিট পেয়েছেন। তাঁর মতে, কিছু বনের গাছ প্রাকৃতিকভাবে বাগানে চলে আসছে এবং সেগুলোর বিক্রির জন্যই কাঠ কাটা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দুর্গম এলাকা হওয়ায় হাতির সাহায্যে গাছ ট্রাক পর্যন্ত পৌঁছানো হয়।

এদিকে, বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, তারা এই কাজের সম্পর্কে শুনেছেন, তবে দুর্গম এলাকা হওয়ায় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন। তবে, তারা আশ্বাস দিয়েছেন যে, কোনোভাবেই যদি বনাঞ্চল থেকে গাছ কাটা হয়, তবে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বন বিভাগের ভূমিকা

টঙ্কাবতী রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রাফি উদ্দোল্লাহ জানিয়েছেন, এ ধরনের গাছ কাটার ঘটনা তাদের কাছে একেবারে অচেনা নয়। তবে, দুর্গমতার কারণে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, জোত পারমিটের অপব্যবহার শনাক্ত হলে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই বিষয়ে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সমাধান এবং প্রতিকার

এই অবস্থা মোকাবেলা করতে হলে প্রশাসন, পরিবেশ অধিকারী সংগঠন, এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রথমত, বন বিভাগের তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে বনাঞ্চলে অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা যায়। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং তাদের আইনি বিষয়ে জানানো উচিত। তৃতীয়ত, যে ব্যক্তিরা জোত পারমিটের অপব্যবহার করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

শেষ কথা

বান্দরবানে বন উজাড় এবং গাছ পাচারের এই ঘটনা পরিবেশ বিপর্যয়ের এক বড় সংকেত। এটি শুধু স্থানীয় মানুষের জীবনকে বিপন্ন করছে, বরং সমগ্র প্রকৃতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এভাবে বনাঞ্চল উজাড় হতে থাকলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদের উচিত, পরিবেশের সুরক্ষায় আরও মনোযোগী হওয়া এবং বন উজাড়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

Call-to-Action: আপনার কি মনে হয় এই ধরনের অবৈধ কার্যক্রমে কেন প্রশাসন আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না? মন্তব্যে আপনার মতামত শেয়ার করুন এবং পরিবেশ রক্ষায় আমাদের আরও সচেতন হতে হবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ