25.4 C
Bangladesh
শুক্রবার, মে ৩০, ২০২৫
spot_img

উৎসব হোক পরিবেশবান্ধব—এবার পহেলা বৈশাখে

নববর্ষের উল্লাস ও পরিবেশের চ্যালেঞ্জ

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির এক মহোৎসব, যেখানে আনন্দ, সম্পর্ক আর নতুন সম্ভাবনার ছোঁয়া থাকে। এই দিনটি আমাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার উৎসব হলেও আধুনিক সময়ে এর উদযাপন রূপ বদলেছে। শহুরে জীবনধারায় নববর্ষের নামে জাঁকজমকপূর্ণ সাজসজ্জা, ডিজে পার্টি, রাসায়নিক রঙ, প্লাস্টিক সামগ্রী এবং শব্দদূষণযুক্ত আয়োজন বেশি পরিলক্ষিত হয়। এসব আয়োজন যতই আনন্দমুখর হোক, প্রকৃতির ওপর এদের প্রভাব মারাত্মক। শব্দ ও বায়ুদূষণ, অতিরিক্ত বর্জ্য, একবার ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ছড়াছড়ি পরিবেশকে বিপন্ন করে তোলে। তাই আজকের প্রেক্ষাপটে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে নববর্ষ উদযাপনকে আরও পরিবেশবান্ধবভাবে ভাবা এবং পালন করা। উৎসব হোক পরিবেশবান্ধব

ঐতিহ্য ও প্রকৃতির মাঝে ভারসাম্য

পরিবেশবান্ধব নববর্ষ উদযাপনের অর্থ হচ্ছে প্রকৃতিকে পাশে রেখে উৎসব পালন করা, একে কৃচ্ছসাধনের সঙ্গে নয়, বরং সচেতনতার সঙ্গে জড়ানো। আমাদের ঐতিহ্য এমনিতেই প্রকৃতিনির্ভর—আলপনা, পান্তাভাত, গ্রামীণ সঙ্গীত, মাটির জিনিসপত্র সবই প্রকৃতির উপাদান দিয়ে তৈরি। এই ঐতিহ্যের পথ ধরেই আমরা আধুনিক পরিবেশসচেতন উদযাপন গড়ে তুলতে পারি। প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে সাজসজ্জা, স্থানীয় ও মৌসুমি খাবারের ব্যবহার, পাট বা কাপড়ের তৈরি সামগ্রী ব্যবহার করলে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব কমে আসে। পাশাপাশি গ্রামীণ শিল্প ও কারুশিল্পের চাহিদাও বাড়ে, যা টেকসই অর্থনীতির দিকেও আমাদের এগিয়ে নেয়।

শব্দ ও ভোগবাদের বিকল্প চিন্তা

আজকাল নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে উচ্চ শব্দ, ডিজে মিউজিক বা আতশবাজি যেন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। অথচ এসব আয়োজন শুধুমাত্র শব্দদূষণই করে না, বরং শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তি ও প্রাণিকুলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারচেয়ে বরং সংস্কৃতির মৌলিক সুরে ফিরে যাওয়াই হোক উত্তম পথ। লোকসঙ্গীত, পল্লীগীতি, নাটক কিংবা কাব্যপাঠ পরিবেশবান্ধব তো বটেই, এটি স্থানীয় শিল্পীদের মঞ্চও করে দেয়। এতে সামাজিক সংযোগ বাড়ে এবং পারিবারিক ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়, যা ডিজে পার্টি দিতে পারে না। উৎসব হোক পরিবেশবান্ধব

ভোগ নয়, সংযমই নববর্ষের সৌন্দর্য

নববর্ষ উপলক্ষে কেনাকাটার নামে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করা হয়, যার বেশিরভাগই একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। বিশেষ করে প্লাস্টিকের পণ্য, কৃত্রিম গিফট প্যাক ও রাসায়নিক প্রসাধন সামগ্রী পরিবেশের ক্ষতি করে দীর্ঘমেয়াদে। এই অভ্যাসের পরিবর্তে যদি আমরা হাতে তৈরি, পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা জৈব পণ্যকে গুরুত্ব দিই, তাহলে পরিবেশও উপকৃত হয় এবং স্থানীয় কারিগরেরাও উৎসাহিত হন। এতে একটি টেকসই ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে, যা উৎসবের গভীরতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

সচেতনতা শুরু হোক ব্যক্তি থেকেই

পরিবেশবান্ধব নববর্ষ উদযাপন সামাজিক আন্দোলন বা বড় উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও, এর সূচনা হতে পারে একক ব্যক্তি বা পরিবারের সচেতনতা থেকে। নিজের বাড়িতে একটুখানি ভিন্নভাবে উদযাপন করলে তা প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। একবার যদি কেউ দেখে—কোনো পরিবার কলাপাতায় খাবার দিচ্ছে, ঘর সাজিয়েছে ফুল আর আলপনায়, কাগজের বদলে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করছে—তবে তাতে তার মধ্যেও আগ্রহ জন্মাবে। ব্যক্তিগত উদাহরণ সমাজে বড় প্রভাব ফেলে, এবং এভাবেই একদিন গড়ে উঠতে পারে পরিবেশবান্ধব নববর্ষ উদযাপনের একটি নতুন ধারা।

একটি জীবন্ত অভিজ্ঞতা: প্রকৃতির সঙ্গে নববর্ষ

আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, গত বছর আমরা ঠিক করেছিলাম ঘরোয়া পরিবেশে নববর্ষ পালন করব, যেখানে থাকবে না কোনো প্লাস্টিক, কোনো উচ্চ শব্দ কিংবা অতিরিক্ত খরচ। আমরা পরিবারের সবাই মিলে উঠোনে আলপনা এঁকেছিলাম চালের গুঁড়ো দিয়ে, আর দুপুরে পান্তা, ইলিশ নয়—ছিল দই-চিঁড়ে, সবজির ভর্তা আর মৌসুমি ফল। অতিথিদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম পাটের ব্যাগ আর নিজের হাতে বানানো শুভেচ্ছাপত্র। এ আয়োজনে বাহ্যিক চাকচিক্য কম ছিল ঠিকই, কিন্তু তার গভীরতা ছিল অসাধারণ। যেন প্রকৃতি নিজেই আমাদের উৎসবে শরিক হয়েছিল।

উপসংহার: নতুন বছর হোক সচেতনতার নতুন সূচনা

নববর্ষ মানেই কেবল আনন্দ নয়, এটি একটি দায়বদ্ধতারও দিন। এ দিন আমরা যেমন নিজের জন্য নতুন লক্ষ্য ঠিক করি, তেমনি প্রকৃতির প্রতিও নতুন করে অঙ্গীকার করতে পারি। পরিবেশবান্ধব নববর্ষ উদযাপন শুধু সময়ের দাবি নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক দৃষ্টান্তও হতে পারে। যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলে, যেখানে উৎসব হয় অনর্থক ভোগ নয়—বরং সজাগ, সংবেদনশীল ও সহনশীল এক জীবনদর্শনের প্রতিফলন। এমন নববর্ষই হোক আমাদের আগামী পথচলার দিশারি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ