পপ সংস্কৃতি আর জলবায়ু পরিবর্তন—দুটো বিষয়কে একসাথে দেখলে আপনার কেমন লাগবে? হয়তো ভাবছেন, কোথায় মার্কিন পপ তারকা সাবরিনা কার্পেন্টারের আবেদনময়ী পারফরম্যান্স, আর কোথায় আমাদের পৃথিবীর পরিবেশ সংকট! কিন্তু একটু গভীরে তাকালে দেখবেন, সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকেও অনেক সময় জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পাওয়া যায়। সাবরিনা কার্পেন্টার
সম্প্রতি লন্ডনের হাইড পার্কে সাবরিনা কার্পেন্টারের একটি কনসার্ট ঠিক তেমনই একটি শিক্ষা আমাদের সামনে এনে দিয়েছে। এটি শুধু একজন শিল্পীর মঞ্চ কাঁপানো পারফরম্যান্সের গল্প নয়, এটি হলো সময়কে চেনার, নিজেকে বদলানোর এবং বৃহত্তর দর্শকের কথা শোনার এক অসাধারণ উদাহরণ। আর এই বদলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সংকটের সমাধানের এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। সাবরিনা কার্পেন্টার
বিতর্ক থেকে পরিবারবান্ধব: সাবরিনা কেন বদলালেন?
যারা সাবরিনা কার্পেন্টারকে চেনেন, তারা জানেন তার পরিচিতি মূলত জেন-জি প্রজন্মের কাছে, এক আবেদনময়ী ও সাহসী শিল্পী হিসেবে। তার গান ‘এক্সপ্রেসো’ দিয়ে তিনি বিশ্ব জয় করেছেন, কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগও কম নয়। অনেকেই বলেন, তিনি গানে গানে যৌনতা উসকে দেন এবং মঞ্চে অতিরিক্ত খোলামেলা পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করেন। সাবরিনা কার্পেন্টার
এই বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালে তার নতুন অ্যালবাম ‘ম্যানস বেস্ট ফ্রেন্ড’-এর প্রচ্ছদ, যেখানে দেখা যায় একজন পুরুষ পেছন থেকে তার চুল টেনে ধরেছে। ছবিটি নারী নির্যাতনের ইঙ্গিত দেয়—এমন অভিযোগে সোচ্চার হয় অনেক সংগঠন।
ঠিক এই সমালোচনার ঝড়ের মাঝেই গত শনিবার লন্ডনের হাইড পার্কে ৬৫ হাজার দর্শকের সামনে মঞ্চে উঠলেন সাবরিনা। কিন্তু এ কোন সাবরিনা? তার চিরচেনা হিট গানগুলো ছিল, প্রাণবন্ত নাচও ছিল, কিন্তু তার পরিবেশনায় ছিল এক চোখে পড়ার মতো সংযম। আগের মতো উসকানিমূলক পারফরম্যান্সের বদলে পুরো পরিবেশনাটি ছিল পরিবারবান্ধব। তিনি যেন সব বিতর্ক মুছে দিয়ে নতুন এক রূপে হাজির হলেন। সিনেমার মতো করে একটি ক্রেনে চড়ে দর্শকদের ওপর দিয়ে উড়ে গেলেন, সবার ভালোবাসার প্রতি জানালেন কৃতজ্ঞতা।
সোজা কথায়, সাবরিনা ‘রুম রিড’ করেছেন। তিনি তার দর্শক, সমালোচক এবং সময়ের ভাষাকে পড়েছেন এবং সে অনুযায়ী নিজের ‘পারফরম্যান্স’ বদলেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এর সাথে পরিবেশের সম্পর্ক কী?
সম্পর্কটা এখানেই। সাবরিনা কার্পেন্টার যা করেছেন, তা হলো প্রতিক্রিয়ার মুখে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া। তিনি তার মূল শক্তি—অর্থাৎ তার গান বা কণ্ঠকে বিসর্জন দেননি, কিন্তু যেভাবে তিনি তা পরিবেশন করেছেন, সেই পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছেন।
এবার আমাদের পৃথিবীর দিকে তাকাই। আমাদের গ্রহটিও প্রতিনিয়ত আমাদের সিগন্যাল বা ‘ফিডব্যাক’ দিয়ে যাচ্ছে।
- কক্সবাজারের ভয়াবহ বন্যা, ইউরোপ-আমেরিকার রেকর্ডভাঙা দাবদাহ, কিংবা মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া—এই সবই হলো প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া।
- আমাদের লাগামহীন ভোগবাদ, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা এবং বন ধ্বংসের মতো কর্মকাণ্ড হলো আমাদের সেই ‘বিতর্কিত পারফরম্যান্স’, যা পৃথিবীকে অসুস্থ করে তুলেছে।
আমাদের গ্রহটি আমাদের বলছে, “তোমাদের পারফরম্যান্স বদলাতে হবে। তোমাদের এই পরিবেশ ধ্বংসের পথ আর গ্রহণযোগ্য নয়।”
সাবরিনা যেমন তার সমালোচকদের কথা শুনেছেন, আমরা কি আমাদের গ্রহের এই আর্তনাদ শুনছি? আমরা কি আমাদের কর্মপন্থা বদলানোর জন্য প্রস্তুত? পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার মূল চ্যালেঞ্জটি এখানেই।
পারফরম্যান্স বদলানো, পরিচয় নয়
সাবরিনার এই পরিবর্তন থেকে আরেকটি বড় শিক্ষা হলো, পরিবর্তন মানেই নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলা নয়। তিনি তার জনপ্রিয় গানগুলো গেয়েই মঞ্চ মাতিয়েছেন, শুধু পরিবেশনার ধরনে পরিবর্তন এনেছেন।
একইভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য আমাদের জীবনযাত্রাকে আমূল বদলে ফেলতে হবে, এমন নয়। আমাদের হয়তো গাড়ি চালানো পুরোপুরি ছাড়তে হবে না, কিন্তু আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে বৈদ্যুতিক গাড়ি বেছে নিতে পারি। আমাদের হয়তো ভোগ পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে না, কিন্তু আমরা ‘ফাস্ট ফ্যাশন’-এর বদলে টেকসই ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য বেছে নিতে পারি।
মূল কথা হলো, আমাদের ‘পারফরম্যান্স’ বা জীবনযাপনের পদ্ধতিকে আরও স্মার্ট, আরও সচেতন এবং পরিবেশ-বান্ধব করতে হবে।
শেষ কথা: একজন শিল্পী থেকে একটি প্রজন্মের প্রতি বার্তা
সাবরিনা কার্পেন্টারের এই ঘটনাটি শুধু বিনোদন পাতার খবর নয়। এটি আমাদের প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী রূপক। এটি শেখায় যে, প্রতিক্রিয়াকে ভয় না পেয়ে তাকে গ্রহণ করতে হয় এবং সময়ের প্রয়োজনে নিজেকে বদলাতে হয়। একজন শিল্পী যদি ৬৫ হাজার মানুষের সামনে নিজের ভুল বা বিতর্কিত দিক শুধরে নিতে পারেন, তাহলে আমরা ৭ বিলিয়ন মানুষ কি আমাদের গ্রহকে বাঁচানোর জন্য নিজেদের অভ্যাসগুলো একটু একটু করে বদলাতে পারি না?
সাবরিনার মতো আমরাও যদি আমাদের গ্রহের ‘ভাষা’ বুঝতে শিখি এবং আমাদের সম্মিলিত ‘পারফরম্যান্স’ পরিবর্তন করি, তবে হয়তো এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংকটটিও আমরা মোকাবেলা করতে পারব।
আপনার মতামত কী?
আপনি কি মনে করেন, পপ সংস্কৃতির বিভিন্ন ঘটনা থেকে পরিবেশ বা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়া সম্ভব? সাবরিনার এই পরিবর্তনের সাথে আমাদের পরিবেশ সংকটের এই রূপক তুলনা আপনার কেমন লাগলো? আপনার ভাবনাগুলো আমাদের সাথে শেয়ার করুন।
টেকসই জীবনযাত্রা এবং পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে আরও জানতে বা আমাদের সাথে কাজ করতে চাইলে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। আসুন, সবাই মিলে আমাদের পারফরম্যান্স বদলে পৃথিবীকে একটি সুন্দর মঞ্চ উপহার দিই।