ঢাকার বায়ুদূষণ পরিস্থিতি আবারও উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। ভোরের শিশির ও সন্ধ্যার কুয়াশা প্রকৃতির শীতল পরশের ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু এই শীতল আবহাওয়ায় দূষণের ঘনঘটা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানীর বায়ুতে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ এতটাই বেড়ে গেছে যে, তা অস্বাস্থ্যকর এবং উদ্বেগজনক। আড়াই কোটি মানুষের এই নগরে বায়ুদূষণের কারণে শ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। বায়ুদূষণ পরিস্থিতি
ঢাকার বায়ুদূষণের বর্তমান অবস্থা
ঢাকা শহর বর্তমানে বায়ুদূষণের জন্য বিশ্বসেরার তকমা লাভ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চাপের কারণে পরিবেশগত উদ্বেগজনক এই ইস্যুটি গুরুত্ব পাচ্ছে না। দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের অনুপস্থিতিতে দূষণ রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। পানি ছিটানোর কাজও বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে যানবাহন এবং ইটভাটাগুলো নির্বিঘ্নে চলতে পারছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঢাকার অবস্থান
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, ঢাকার বায়ু শীতের শুরুতেই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় রয়েছে। গত বুধবার ঢাকায় পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ছিল ডব্লিউএইচওর মানমাত্রার চেয়ে ৪৩ শতাংশ বেশি। আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনে দেখা যায়, নভেম্বর মাসে ঢাকার অবস্থান ছিল বিশ্বের শীর্ষ দুই-তিনটি দূষিত শহরের মধ্যে।
দূষণের কারণ
- বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্প-কারখানার বৃদ্ধি, এবং অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ। বিশেষ করে ঢাকায় যানবাহন, নির্মাণ সাইট এবং ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও কণা পদার্থ (পিএম) বায়ু দূষণের মূল উৎস। যানবাহনের ধোঁয়া, কৃষি কার্যক্রম (যেমন ফসলের খড় পোড়ানো), এবং শিল্পের বর্জ্যও উল্লেখযোগ্যভাবে দূষণ সৃষ্টি করছে।
- .বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায়। ২০১৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো:
- ইটভাটা
- যানবাহনের ধোঁয়া
- নির্মাণ সাইটের ধুলো
সরকারের পদক্ষেপ এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা
সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। ২০২০ সালে হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল, যার মধ্যে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা এবং পানি ছিটানোর ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে এই নির্দেশনাগুলো কার্যকর হয়নি। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হলেও সিটি করপোরেশনগুলোতে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব দেখা যাচ্ছে
স্বাস্থ্য সমস্যা
বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর আনুমানিক ৮০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাজনিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে শীতকালে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। বায়ুদূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা যায়
সমাধানের পথ
বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে যাতে তারা পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। কিছু সম্ভাব্য সমাধান হলো:
- নির্মাণ সাইটে পানি ছিটানো: এটি ধুলা কমাতে সাহায্য করবে।
- যানবাহনের নির্গমন পরীক্ষা: পুরোনো ও অযোগ্য যানবাহন নিষিদ্ধ করা।
- সবুজায়ন প্রকল্প: গাছ লাগানো এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা।
এছাড়া, স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশনগুলোকে কার্যকরভাবে কাজ করতে হবে যাতে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়
বায়ুদূষণ একটি গুরুতর সমস্যা যা বাংলাদেশের পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা, অন্যথায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। জনগণের সচেতনতা এবং অংশগ্রহণও এই সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
Call-to-Action: আপনার মতামত জানাতে নিচের মন্তব্য বিভাগে লিখুন এবং আমাদের ব্লগ সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবেন না!