খরা এবং ভূমি ক্ষয় বৈশ্বিক পরিবেশের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। এই দুটি বিষয় আমাদের জীবনের গভীরে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত বিপর্যয়, এবং জলসম্পদের সংকট যখন সামনে আসে, তখন খরা এবং ভূমি ক্ষয়ের প্রভাব আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে বিশদ আলোচনার জন্য, গত সোমবার (২ ডিসেম্বর) সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের মরুকরণ প্রতিরোধ কনভেনশনের (ইউএনসিসিডি) ষোড়শ সম্মেলনে পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান খরা এবং ভূমি ক্ষয়ের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক পদক্ষেপের গুরুত্ব তুলে ধরেন। খরা ও ভূমি ক্ষয়
খরা এবং ভূমি ক্ষয়ের বিপদ:
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা এবং ভূমি ক্ষয় আজ একটি অপ্রতিরোধ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং মানুষের অব্যবস্থাপনা—এই তিনটি কারণে কৃষি, বন, জলাশয়, এবং পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক পানি সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে ৪০ শতাংশ ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা জীবনযাত্রার মৌলিক ভিত্তি ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
এটি শুধু একটি সংখ্যাগত সংকট নয়—এটি আমাদের সমাজের এবং অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তির উপর আঘাত। যখন পৃথিবী শুকিয়ে যায়, তখন কৃষকরা তাদের ফসল হারায়, গবাদিপশু খাদ্যের অভাবে ভুগতে থাকে, এবং বনাঞ্চল ধ্বংসের মুখে পড়ে। উপরন্তু, এক একটি খরা বা ভূমি ক্ষয়ের ঘটনা একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্ম দেয়—যেমন বন্যা, ঝড়, এবং আরও গভীর জলবায়ু বিপর্যয়।
রিজওয়ানা হাসান তার বক্তব্যে এসব সংকটের বিরুদ্ধে একসাথে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “এটি শুধু একটি দেশ বা অঞ্চলের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যেখানে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি।” খরা ও ভূমি ক্ষয়
সমস্যা ও সমাধান:
১. টেকসই জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা:
বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই খরা এবং ভূমি ক্ষয়ের সবচেয়ে বড় কারণ হল পানি সংকট। আমাদের জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি শুধুমাত্র অদক্ষ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর। রিজওয়ানা হাসান বলেন, “এটি একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে হবে—পানি ব্যবস্থাপনার ধারণা আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।” প্রতিটি দেশকে তাদের পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং সংরক্ষণের জন্য কার্যকরী নীতি গ্রহণ করতে হবে।
তবে, শুধু প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়। বিশ্বজুড়ে একযোগিতার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী আইন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। উন্নত দেশগুলোকে তাদের প্রযুক্তি এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে খরা প্রভাবিত দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে।
২. কৃষি ও বনভূমির টেকসই ব্যবস্থাপনা:
বাংলাদেশ, ভারত, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, এমনকি আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের কিছু অংশের কৃষকদের জন্য খরা একটি দৈনিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খরা এবং ভূমি ক্ষয়ের কারণে কৃষকদের ফসলের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, এবং বনভূমির অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এর ফলে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, “কৃষকদের জন্য উপযুক্ত সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, যেন তারা নিজেদের অঞ্চলে আরও টেকসই কৃষিকাজ চালিয়ে যেতে পারেন।” কৃষি ব্যবস্থাপনার জন্য খরাপ্রবণ অঞ্চলের কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি এবং জ্ঞান প্রদান করার প্রয়োজন।
এছাড়াও, বনভূমির সংরক্ষণ এবং পুনঃপ্রতিস্থাপন পরিকল্পনা জরুরি। বৃক্ষরোপণ এবং বনসুরক্ষা কার্যক্রম যাতে স্থানীয়ভাবে কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
৩. স্থানীয় সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন:
বিভিন্ন খরা এবং ভূমি ক্ষয়ের সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবিত হয় স্থানীয় কৃষক, বননিবাসী, আদিবাসী জনগণ এবং নারীরা। এই সম্প্রদায়গুলো, যারা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত, তাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটছে। তাদেরকে কেবল প্রকল্পের সুবিধাভোগী হিসেবে নয়, বরং প্রকল্পের অংশীদার হিসেবে দেখতে হবে।
রিজওয়ানা হাসান বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, “স্থানীয় সম্প্রদায়কে কার্যকরভাবে যুক্ত করতে হবে, কারণ তারা জানে তাদের সমস্যা কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে।” স্থানীয় জ্ঞান এবং প্রযুক্তির সংমিশ্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা:
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এবং জাতীয় সরকারের বিভিন্ন অংশীদারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নেতৃত্বই বিশ্বব্যাপী এই সংকটের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে।
জাতিসংঘের মতো ফোরামগুলিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দৃষ্টিভঙ্গির শক্তিশালী প্রভাবই চূড়ান্ত সাফল্য আনতে পারে। রিজওয়ানা হাসান উল্লেখ করেন, “আমাদের জাতীয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে সঠিক নেতৃত্বের প্রয়োজন।”
খরা এবং ভূমি ক্ষয় একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা, যা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়েরও কারণ। এই সমস্যার সমাধান একদিনে সম্ভব নয়, তবে সমন্বিত প্রচেষ্টা, স্থানীয় জনগণের ক্ষমতায়ন এবং বৈশ্বিক সহায়তা নিয়ে আমরা এটি মোকাবিলা করতে পারি। আমাদেরকে একসাথে কাজ করতে হবে—শুধুমাত্র বৈশ্বিক উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা একে অপরকে সাহায্য করতে পারি এবং পৃথিবীকে একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।
Call to Action: এমন গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত বিষয়গুলো নিয়ে আরও জানার জন্য আমাদের সাইটে ভিজিট করুন এবং মন্তব্যের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান।