পলিথিন, যা একসময় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল, এখন পরিবেশের জন্য এক বড় হুমকি। বাংলাদেশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, পলিথিনের ব্যবহার এতটাই বিস্তার লাভ করেছে যে, এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও পলিথিনের ব্যবহার কমানো এখনো এক বড় চ্যালেঞ্জ। তবে, এই ব্যবহারের বিরুদ্ধে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে কিছু সাফল্য এসেছে, তবে এর বিকল্প সম্পর্কে সচেতনতা এবং সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এখনও অপরিহার্য। পলিথিন ব্যবহার বন্ধের
পলিথিন: পরিবেশের জন্য বিরাট হুমকি
পলিথিন সহজে ব্যবহারযোগ্য এবং সস্তা, কিন্তু একে ব্যবহারের ফলে পরিবেশের উপর যে ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে, তা সত্যিই উদ্বেগজনক। পলিথিন মাটির গুণগত মান নষ্ট করে, নদী-নালায় গিয়ে জমা হয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পলিথিনের ব্যবহার না কমালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও বাড়বে, যা আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, পলিথিনের ব্যবহার রোধে কি কিছু করা সম্ভব? পরিবেশবিদরা মনে করেন, শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। পলিথিন ব্যবহার বন্ধের
বাজারে পলিথিনের অবাধ ব্যবহার: একটি বাস্তব চিত্র
ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, এখনও পলিথিনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে চলছে। বিশেষ করে স্থানীয় বাজারগুলোতে, যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার আগ্রহ একে অপরের কাছে পলিথিনের ব্যাগ সরবরাহ করার জন্য। বাজারের অনেক ক্রেতা বলেন, “পলিথিনের দাম মাত্র ২৫ পয়সা, আর কাপড়ের ব্যাগ কেনার জন্য আমাকে ২৫ টাকা দিতে হবে—এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
অনেক ক্ষেত্রেই বিক্রেতারাও পলিথিন ছাড়া বিক্রি করতে প্রস্তুত নন। বিক্রেতারা জানান, “পলিথিন ছাড়া বিকল্প কিছু ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। যদি সরকারের পক্ষ থেকে বিকল্প কিছু সরবরাহ করা হয়, আমরা অবশ্যই সেটা ব্যবহার করবো।”
এখানে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, পলিথিনের বিকল্প উপকরণ তৈরি করা, যা সহজলভ্য ও সস্তা হবে। সাধারণ মানুষের কাছে এখনো পলিথিনের বিকল্প হিসেবে কাপড় বা পাটের ব্যাগ অনেকটাই বিলাসিতার মতো।
সুপার শপগুলোতে কিছু সাফল্য, কিন্তু হাটবাজারে কঠিন বাস্তবতা
তবে, সুপার শপগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছে। অনেক সুপার শপে এখন পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, পাটের ব্যাগের দাম অনেক বেশি—“কেন ১৪৫ টাকা? আগে তো ফ্রি পেতাম!” বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকে।
কিছু সুপার শপ ম্যানেজাররা জানান, “আমরা কাউকে বাধ্য করছি না। যারা চান, তারা কিনছেন। তবে আমরা বিকল্প হিসেবে কাপড়ের ব্যাগ এবং কাগজের ব্যাগ দিচ্ছি, যা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে।” কিন্তু সুপার শপে এ ধরনের বিকল্প ব্যবহারের পাশাপাশি, হাটবাজারগুলোতে এখনও পলিথিনের ছড়াছড়ি, যা উদ্বেগজনক।
পলিথিন উৎপাদন বন্ধ: এক বড় চ্যালেঞ্জ
এখন পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করার চিন্তা চলছে, কিন্তু সেটা তত সহজ নয়। প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারকরা বলছেন, হঠাৎ করে পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করা সম্ভব নয়, কারণ এই খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বহু কোটি টাকা। তারা আরও জানান, এতে প্রায় ৬ হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই, প্লাস্টিকের উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ করার আগে, তার বিকল্প পণ্য বাজারে আনতে হবে, যা সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব।
এছাড়া, পলিথিনের পুনঃব্যবহার এবং পুনঃচক্রের জন্য নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলে, পরিবেশের ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে।
বিকল্প উপকরণ ও সচেতনতা: সমাধানের মূল চাবিকাঠি
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পলিথিন উৎপাদন বন্ধের কাজ চলছে, এবং সরকার ইতোমধ্যে ১৫ কোটি পাটের ব্যাগ উৎপাদন করেছে। তারা জানাচ্ছেন, ২০০টির বেশি অভিযান চালিয়ে প্রায় ২৬ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে এবং আগামী দিনে এসব অভিযান আরও কঠোর করা হবে।
তবে, পরিবেশবিদরা মনে করেন, পলিথিনের ব্যবহার কমাতে সরকারকে আরও কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সঠিক বিকল্প ব্যবস্থা না হলে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা অসম্ভব।
উপসংহার: পলিথিন মুক্ত সমাজ গড়তে একযোগী প্রচেষ্টা
পলিথিনের ব্যবহার রোধ করতে হলে সবাইকে একযোগভাবে কাজ করতে হবে। সরকার, ব্যবসায়ী মহল, পরিবেশবিদ এবং সাধারণ মানুষ—সবাইকে মিলে পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সস্তা ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প উপকরণের বাজারে সরবরাহ এবং পলিথিনের পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
আজকের দিনে, আমরা যদি পলিথিনের ব্যবহার রোধ না করি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের প্রজন্মের জন্য পরিবেশ সুরক্ষিত রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সকলের দায়িত্ব নিতে হবে এবং পলিথিন মুক্ত সমাজ গড়ার দিকে একত্রিত হয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।