ভারতের আগ্রাসনের কারণে ফেনী নদী, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মুহুরি সেচ প্রকল্প, এখন প্রায় মরণদশায়। প্রায় এক যুগ ধরে ভারতের অনিয়ন্ত্রিত পানির প্রত্যাহার ফেনী নদীকে শুকিয়ে ফেলেছে, যা দেশের কৃষিক্ষেত্র এবং পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই পোস্টে আমরা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করবো কিভাবে ভারতের আগ্রাসন ফেনী নদীকে অভিশপ্ত করছে এবং এর ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ ও কৃষিক্ষেত্র কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফেনী নদীর মরণদশা
ফেনী নদীর উপর ভারতের একক আধিপত্য
ফেনী নদী, যা বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলার ভগবান টিলা থেকে উৎপন্ন হয়ে চট্টগ্রামের মিরস্বছড়াইয়ের আমলীঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত, বর্তমানে ভারতের একক আধিপত্যের শিকার হয়েছে। ভারত গত প্রায় এক দশক ধরে ৩৭টি স্থানে পাম্প বসিয়ে ফেনী নদী থেকে অবিরাম পানি তুলে নিচ্ছে, যার ফলে নদী শুকিয়ে তার বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠছে। এই পানির অভাবে নদীর প্রাকৃতিক স্রোত বন্ধ হয়ে গেছে, যা পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং কৃষকদের জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
ভারতের ইনটেক ওয়েল প্রকল্পের আশঙ্কা
ভারত যদি ইনটেক ওয়েল প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, তবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মুহুরি সেচ প্রকল্প হুমকির মুখে পড়বে। ফেনী নদীর পানির ওপর ভারতের এই একপাক্ষিক নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের কৃষিকাজ এবং পানি সংরক্ষণের জন্য বিপদজনক হতে পারে। ফেনী নদীর পানি নিয়ন্ত্রণে ভারতে অবৈধভাবে পাম্প স্থাপন এবং পানি উত্তোলন বাংলাদেশের প্রতি ভারতের হস্তক্ষেপের স্পষ্ট প্রমাণ। ফেনী নদীর মরণদশা
ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর, নয়া দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এই স্মরকে ভারতের ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করার অধিকার দেওয়া হয়। এই চুক্তির ফলে ফেনী নদীর পানির পরিমাণ কমে গিয়েছে এবং নদী প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের কৃষকরা ফেনী নদীর পানির জন্য বিপদজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যেখানে পানি তুলতে গেলে তাদের অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বিএসএফ কর্তৃক।
পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব
ফেনী নদীর শুকিয়ে যাওয়ার ফলে নদীর তীরে বসবাসকারী ও কৃষকদের জীবনযাত্রা প্রভাবিত হচ্ছে। নদীতে গোসলের পানিও কমে গিয়েছে, যা স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করছে। নদীর তীরবর্তী এলাকায় কৃষকেরা সবজিসহ নানা প্রজাতির ফসল চাষ করছেন, কিন্তু পানির অভাবে তাদের কাজ কঠিন হয়ে পড়ছে। অবৈধভাবে পাকা হাউজ নির্মাণ এবং পানির পাইপলাইন স্থাপন বাংলাদেশের পরিবেশ এবং সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করছে।
আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির লঙ্ঘন
১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী, সীমান্তের শূন্য রেখা থেকে উভয় পাশে ১৫০ গজের ভিতরে স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা নিষেধ। কিন্তু ভারত ফেনী নদীর তীরে অবৈধভাবে ৩৭টি পাকা পাম্প হাউজ স্থাপন করে এই চুক্তির লঙ্ঘন করছে। এর ফলে ফেনী নদীর অস্তিত্ব হ্রাস পাচ্ছে এবং নদী একসময় ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় প্রতিক্রিয়া ও আন্দোলন
বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ ছাত্রলীগের একদল সন্ত্রাসীর নির্মম নির্যাতনে নিহত হন, যখন তিনি ফেনী নদীর পানির ন্যায্যতা সম্পর্কে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। এ ঘটনার পর থেকে ফেনী নদীর পানির প্রতি জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলন (পবা) ধূলা দূষণ এবং পানিবদ্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, তবে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
সমাধানের পথ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ফেনী নদীর পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন সুসংহত পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। বাংলাদেশের সরকারকে ভারতে চাপ দেওয়া উচিত যাতে নদীর পানির ওপর ভারতের একপাক্ষিক নিয়ন্ত্রণ বন্ধ হয়। পাশাপাশি, ফেনী নদীর পানির বিকল্প উৎস খোঁজা এবং সেচ প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন করা প্রয়োজন যাতে কৃষকদের জীবনযাত্রা সুরক্ষিত থাকে।
উপসংহার: সক্রিয় পদক্ষেপের প্রয়োজন
ভারতের আগ্রাসনে ফেনী নদীর মরণদশা বাংলাদেশের পরিবেশ এবং কৃষিক্ষেত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি। সরকারের সাথে সাথে সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও উদ্যোগই এই সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পরিবেশ সংরক্ষণে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া ফেনী নদীর পুনরুজ্জীবন সম্ভব হবে না।
আপনার মতামত জানাতে মন্তব্য করুন এবং ফেনী নদী ও বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণে আপনার অবদান রাখুন!