বাংলাদেশে প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ পরিবেশ এবং মানবস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সারা দেশে প্রায় ১,৫০০টিরও বেশি অবৈধ পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে, যা পরিবেশকে ধ্বংস করছে এবং নদী ও সাগরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বর্ষাকালে ড্রেনেজব্যবস্থার ভাঙনের ফলে প্লাবনের ঝুঁকি বাড়ছে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের নানা রোগের কারণ হচ্ছে এই দূষণ। পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সংকটের নতুন মাত্রা
পলিথিন ও প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার: পরিবেশের বিপর্যয়
পলিথিন উৎপাদনের সাথে সাথে প্লাস্টিক ও পলিথিনের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশকে বিপর্যস্ত করছে। প্লাস্টিক এবং পলিথিনের এই ব্যবহারে নদী ও সাগরগুলো ধ্বংস হচ্ছে, বর্ষাকালে ড্রেনেজব্যবস্থার ভাঙনের কারণে প্লাবনের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এতে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নানা ধরনের প্রভাব পড়ছে, যেমন শ্বাসকষ্ট, কিডনি রোগ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এবং ক্যান্সারের মতো গুরুতর রোগের সম্ভাবনা বাড়ছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক: মানবদেহে প্রবেশের পথ
পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে বাতাস, পানি এবং খাবারের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের ব্যাগ তৈরির উপকরণগুলোর মধ্যে থাকা রাসায়নিক পদার্থ যেমন বিসফেনল এ (বিপিএ) এবং ফ্যালেটস শরীরে জমা হয়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করছে। এছাড়া, পলিথিন ও প্লাস্টিক পোড়া হলে ডাইঅক্সিন এবং ফুরানের মতো অত্যন্ত বিষাক্ত ধোঁয়া নির্গত হয়, যা বায়ুদূষণের মাধ্যমে শ্বাসযন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
প্রাকৃতিক জীবন ও প্লাস্টিক দূষণ
প্লাস্টিক দূষণের ফলে সামুদ্রিক প্রাণীদের ওপরও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। সামুদ্রিক কচ্ছপগুলো প্লাস্টিকের ব্যাগগুলোকে জেলিফিশ ভেবে ভুল করে খেয়ে ফেলছে, যা তাদের পরিপাকতন্ত্রকে বিনষ্ট করছে এবং অপুষ্টি, অনাহার ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণ সাগরের খাদ্য-শৃঙ্খলে প্রবেশ করে ক্ষুদ্রতম প্লাঙ্কটন থেকে শুরু করে বৃহাদাকার তিমিরও প্রাণহানি হচ্ছে।
পরিবেশ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের পরামর্শ অনুযায়ী, বাংলাদেশে পলিথিনের ব্যবহার কমাতে মোবাইল কোর্টের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। পরিবেশ আইন সংশোধনের মাধ্যমে প্রশাসনিক জরিমানার ক্ষমতা বাড়ানো এবং প্লাস্টিকদূষণ সংক্রান্ত কার্যকর বিধিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটপণ্যের ও তন্তুজাতীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রণোদনা ও উৎসাহ প্রদানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সংকটের নতুন মাত্রা
সরকারি উদ্যোগ ও চ্যালেঞ্জ
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা ঘোষণা অনুযায়ী, নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদনকারী কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও সমন্বিত মনিটরিং টিম গত বছর থেকে এই অভিযানে ৪১৪টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং আনুমানিক ৫০ হাজার ৫৫৬ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করা হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী, পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর। সকলকে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে, অন্যথায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপসংহার: সচেতনতা ও সহযোদ্ধার প্রয়োজন
প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ বাংলাদেশের নদী ও সাগরের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে প্লাস্টিক দূষণের ফারাক কমাতে ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার, প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধি, রিসাইক্লিংয়ের উন্নতি এবং পরিবেশ বান্ধব বিকল্প পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোই একমাত্র উপায় বাংলাদেশকে প্লাস্টিক দূষণের ভীষণ চ্যালেঞ্জ থেকে রক্ষা করতে পারে।