পলিথিনের ভয়াল ছোবল: বাংলাদেশের নদীগুলো কী বাঁচবে?

বাংলাদেশের নদী ও জলাশয়গুলো আজ প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণের ভারে মুমূর্ষু হয়ে উঠেছে। বিশ্বখ্যাত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরের নদীতে প্রতি ঘনমিটার পানিতে গড়ে ৩৬ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে, যা বিশ্বের অনেক নদীর চেয়ে বহুগুণ বেশি। এই উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পলিথিনের ভয়াল ছোবল

প্লাস্টিক দূষণের পরিমাপ: ভয়ংকর সংখ্যা

প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ পরিমাপের অন্যতম প্রধান সূচক হলো প্রতি কেজি পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের (এমপি) কণার সংখ্যা। চীনের ইয়ং চিঙ নদীতে প্রতি ঘনমিটার পানিতে ৮০২টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে, যা বাংলাদেশে পাওয়া মাত্রার চেয়ে অনেক কম। ইউরোপের পর্তুগালের অন্তুয়া নদীতে এই সংখ্যা ৫৮ থেকে ১৯৭টির মধ্যে ভেদাভেদ করে। তবে, বাংলাদেশের টঙ্গী খালে প্রতি ঘনমিটার পানিতে ৬০ হাজারেরও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে, যা দেশকে বিশ্ব প্লাস্টিক দূষণের মানচিত্রে ১৭৭তম স্থানে নিয়ে গেছে।

ঢাকার নদী ও জলাশয়ে প্লাস্টিক দূষণের বাস্তবতা

বিশ্বখ্যাত গবেষণা জার্নাল এলসেভিয়ারের এক প্রবন্ধে উঠে এসেছে ঢাকা শহরের হ্রদ ও আশপাশের নদীগুলোর মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের ভয়ংকর পরিমাণ। তুরাগ নদ, বুড়িগঙ্গা নদী, শীতলক্ষ্যা নদী, বালু নদ, ডেমরা খাল, টঙ্গী খাল ছাড়াও হাতিরঝিল, ধানমণ্ডি ও গুলশান লেকসহ ১৯টি স্থানে পানি ও পলির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, টঙ্গী খালের পানিতে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক কণা রয়েছে, তার পর বালু নদ, বুড়িগঙ্গা নদী ও ধানমণ্ডি লেকের পানিতে এই দূষণ চিহ্নিত হয়েছে। পলিথিনের ভয়াল ছোবল

শহর বনাম গ্রামীণ: প্লাস্টিক দূষণের বিশাল ফারাক

বাংলাদেশের শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকার নদীতে প্লাস্টিক দূষণের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। গ্রামীণ এলাকার নদী যেমন আত্রাই ও করতোয়া নদীতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ ১০০ থেকে ১৫০টি, শহরাঞ্চলের নদীতে এই সংখ্যা ৩০০ থেকে ৪০০ পর্যন্ত বেড়েছে। রাজধানীর নদী ও লেকে গড়ে পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংখ্যা ৩৬ হাজার কণা, যা গ্রামীণ এলাকার তুলনায় শতগুণ বেশি। এই কারণেই বাংলাদেশের এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই) সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে অবস্থান ১৭৭তম হয়েছে।

প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহারের বিস্ফোরণ

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ মিলিয়ন টন পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে, যার মাত্র ৩৭ শতাংশই রিসাইক্লিং করা সম্ভব হচ্ছে। প্লাস্টিকের ব্যবহারে ব্যাপক বৃদ্ধির পাশাপাশি, দেড় হাজারেরও বেশি অবৈধ পলিথিন কারখানা দেশের বিভিন্ন স্থানে কার্যরত রয়েছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের অতিরিক্ত ব্যবহারে নদী ও সাগরের পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, বর্ষাকালে ড্রেনেজব্যবস্থার ভাঙন ঘটছে এবং মানবস্বাস্থ্যের নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

পরিবেশ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের পরামর্শ অনুযায়ী, বাংলাদেশে পলিথিনের ব্যবহার কমাতে মোবাইল কোর্টের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। পরিবেশ আইন সংশোধনের মাধ্যমে প্রশাসনিক জরিমানার ক্ষমতা বাড়ানো এবং প্লাস্টিকদূষণ সংক্রান্ত কার্যকর বিধিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটপণ্যের ও তন্তুজাতীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রণোদনা ও উৎসাহ প্রদানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

সরকারি উদ্যোগ ও চ্যালেঞ্জ

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা ঘোষণা অনুযায়ী, নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদনকারী কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও সমন্বিত মনিটরিং টিম গত বছর থেকে এই অভিযানে ৪১৪টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং আনুমানিক ৫০ হাজার ৫৫৬ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করা হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী, পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর। সকলকে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে, অন্যথায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপসংহার: সচেতনতা ও সহযোদ্ধার প্রয়োজন

প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ বাংলাদেশের নদী ও সাগরের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে প্লাস্টিক দূষণের ফারাক কমাতে ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার, প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধি, রিসাইক্লিংয়ের উন্নতি এবং পরিবেশ বান্ধব বিকল্প পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোই একমাত্র উপায় বাংলাদেশকে প্লাস্টিক দূষণের ভীষণ চ্যালেঞ্জ থেকে রক্ষা করতে পারে।

#প্লাস্টিক #পলিথিন #নদী #পরিবেশ_দূষণ #জলবায়ু_পরিবর্তন #বাংলাদেশ #পরিবেশ_রক্ষা #পানির_দূষণ