বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত সমস্যা। এর প্রভাব এখন আমাদের কৃষি খাতেও স্পষ্ট। বিশেষ করে বাংলাদেশে বোরো চাষে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, যা একদিকে কৃষকদের জন্য সংকট তৈরি করছে, অন্যদিকে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও এক বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যশোরের ভবদহ অঞ্চলের বোরো চাষে পানি না নামার কারণে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। এই পরিস্থিতি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ কৃষির উপর প্রভাব ফেলছে। চলুন, বিস্তারিত জানি এই পরিস্থিতি সম্পর্কে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা: কেন তা বাড়ছে?
যশোরের ভবদহ অঞ্চলের বিলগুলোয় জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি এবছর মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে নদী এবং খালগুলো দিয়ে পানি নিষ্কাশন ঠিকমতো না হওয়া। নদীটির পলি পড়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যার কারণে অনেক এলাকায় পানি জমে গিয়ে বিস্তৃত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরের অতিবৃষ্টি এবং নদী খনন কাজের দীর্ঘসূত্রিতায় এই অঞ্চলের প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে এবার বোরো চাষের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কৃষকের দুর্দিন: সেচের মাধ্যমে বাঁচানোর চেষ্টা
বোরো মৌসুম শুরু হয়েছে, কিন্তু ভবদহের বিলগুলো এখনও জলমগ্ন। অনেক কৃষকই সেচ মেশিন ব্যবহার করে জমির পানি বের করার চেষ্টা করছেন, তবে তারপরও বেশিরভাগ বিলের জমি তলিয়ে রয়েছে। একদিকে কৃষকদের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জমি কমে যাচ্ছে। কৃষক গোপাল মণ্ডল জানান, প্রতি বিঘায় প্রায় ২ হাজার ২০০ টাকা খরচ করে শ্যালো মেশিন দিয়ে জমির পানি বের করার চেষ্টা করছেন। এখন পর্যন্ত, এক মাসের চেষ্টায় প্রায় ৪০০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করা সম্ভব হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
কেন বোরো চাষে সংকট?
বোরো চাষের জন্য যে সময়ের মধ্যে জমি প্রস্তুত করতে হয়, তা ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। অথচ জলাবদ্ধতা এবং পানি নিষ্কাশনে সমস্যা থাকার কারণে, অনেক কৃষক জমিতে ধান চাষ করতে পারেননি। ভবদহ অঞ্চলের ৫২টি বিলের মধ্যে বেশ কিছু বিল এখনও পানিতে ভরা, এবং কোথাও কোথাও শুধুমাত্র আগাছা ও শাপলা ভাসছে।
সেচ কার্যক্রম: কিছুটা আশার আলো
ভবদহ অঞ্চলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বর্তমানে ৩৩৮.২৭৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে পানি নামানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পাইলট চ্যানেল কাটার মাধ্যমে কয়েকটি নদী এবং খালের পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে, যা কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে, ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, নদী খনন কাজের অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর গতিতে হওয়ায় এ বছর বোরো চাষের পরিমাণ আরও কমে যেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা
যে পরিস্থিতি আমরা বর্তমানে দেখছি, তা শুধু ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের এক নির্দিষ্ট ফলস্বরূপ। অতিরিক্ত বৃষ্টি, নদী খনন সমস্যার কারণে পানি নিষ্কাশনে বাধা, এবং তাপমাত্রার ওঠানামা সবকিছুই এই বিপর্যয়ে অবদান রাখছে। জলবায়ু পরিবর্তন কৃষি সেক্টরের জন্য বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে, যা আমাদের কৃষকদের জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভবিষ্যতে কী করা প্রয়োজন?
বর্তমানে ভবদহ অঞ্চলের কৃষকদের যে জলাবদ্ধতার সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা শুধুমাত্র স্থানীয় নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ একটি বৃহত্তর জাতীয় সমস্যা। বাংলাদেশে যেখানে প্রতি বছর বন্যা, অতিবৃষ্টি, এবং নদী ভাঙ্গন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে কৃষিক্ষেত্রে এই ধরনের সংকট মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরি। আগামী দিনে এই সমস্যাগুলোর সমাধানে কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১. নদী ও খাল খনন এবং পানির প্রবাহ বৃদ্ধি
ভবদহ অঞ্চলের প্রধান সমস্যা হল নদী এবং খালের মধ্যে পানি নিষ্কাশন সঠিকভাবে না হওয়া। এর ফলে, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং বোরো চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করা যাচ্ছে না। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দ্রুত নদী এবং খাল খনন করা প্রয়োজন। বিশেষত, পলি জমে যাওয়া নদীগুলোর পুনঃখনন এবং নতুন পানিপথ তৈরির মাধ্যমে জল নিষ্কাশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা উচিত। এর মাধ্যমে জমির পানি বের করা সহজ হবে এবং কৃষকরা সময়মতো চাষ করতে পারবেন।
২. নতুন সেচ ব্যবস্থা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার
পানি সংকট ও জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে উন্নত সেচ ব্যবস্থা চালু করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান সেচ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নেই। সুতরাং, কৃষকদের নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে সেচ দেওয়ার পদ্ধতি শেখানো এবং আধুনিক সেচ যন্ত্রপাতি প্রদান করা উচিত। “ড্রিপ ইরিগেশন” এবং “স্প্রিংকলার সিস্টেম” এর মতো আধুনিক সেচ ব্যবস্থা পানি বাঁচানোর পাশাপাশি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।
৩. জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি
বাংলাদেশের কৃষকরা মূলত মৌলিক কৃষি জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ থাকেন, তবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার প্রভাব সম্পর্কে তাদের কম জানা রয়েছে। এর ফলে, কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলির মোকাবিলা করতে সক্ষম হচ্ছেন না। সুতরাং, কৃষকদের জন্য একটি ব্যাপক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন, যেখানে তারা জলবায়ু পরিবর্তন, এর প্রভাব, এবং জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান পাবেন। এতে তারা নতুন চাষ পদ্ধতি ও কৌশল গ্রহণ করতে পারবেন, যা তাদের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনবে।
৪. কৃষকদের জন্য ঋণ সুবিধা এবং অর্থনৈতিক সহায়তা
কৃষকদের উপর চাপ কমাতে এবং তাদের কৃষি কার্যক্রম পুনরায় সচল করতে, সরকারকে ঋণ সুবিধা এবং সঠিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলাবদ্ধতা জনিত সমস্যার কারণে কৃষকরা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করা দরকার। এই সহায়তা কৃষকদের কৃষি কাজে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করবে এবং তাদের সামগ্রিক উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।
৫. ফসলের বৈচিত্র্য এবং জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের চাষ
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ যা কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদী সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ফসলের চাষ এবং জলবায়ু সহিষ্ণু জাতের বীজ ব্যবহার কৃষকদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে। চাষের জন্য কাস্টমাইজড বীজ এবং এমন ফসলের জাত নির্বাচন করা, যা অল্প পানি বা স্বল্প আর্দ্রতায় বৃদ্ধি পায়, সেটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি রেজিলিয়েন্ট থাকতে সাহায্য করবে।
৬. নিরাপদ এবং টেকসই কৃষি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা
জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করার জন্য নতুন প্রযুক্তি ও গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি প্রযুক্তির উন্নতি, যেমন জলবায়ু সহিষ্ণু বীজ, কম পানি প্রয়োজনীয় ফসল, উন্নত সেচ প্রযুক্তি, এবং নতুন কৃষি পদ্ধতির উদ্ভাবন গবেষণার মাধ্যমে কৃষকদের সেবা দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি উদ্যোগগুলো একত্রিত হয়ে এই বিষয়ে কাজ করলে কৃষি খাতকে আরও টেকসই ও ভবিষ্যৎপ্রস্তুত করা সম্ভব।
৭. প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস এবং প্রস্তুতি গ্রহণ
বাংলাদেশের কৃষকরা সঠিক পূর্বাভাসের অভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঠিক সময়ে প্রস্তুতি নিতে পারেন না। কৃষকরা যদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট সম্পর্কে জানতেন, তবে তারা তাদের কৃষি পরিকল্পনা প্রাসঙ্গিকভাবে তৈরি করতে পারতেন। এর জন্য, সরকার ও প্রাসঙ্গিক সংস্থাগুলির জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তির মাধ্যমে পূর্বাভাস ব্যবস্থা শক্তিশালী করা উচিত।
আমাদের করণীয়
আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। সরকার, কৃষক এবং সাধারণ জনগণের একত্রিত প্রচেষ্টাই এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার উপায়। এছাড়া, কৃষকদের সঠিক প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান করা উচিত।
মন্তব্য করুন: আপনার কি মনে হয়, বোরো চাষে জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে সরকারের ভূমিকা কীভাবে আরো শক্তিশালী হতে পারে? আপনার মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করুন।