দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প পরিবেশগত এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য বড়ো একটি সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম যোগাযোগ প্রকল্প, কিন্তু নির্মাণ কার্যক্রমের কারণে পরিবেশের ক্ষতি এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের জন্য যে বিপদ সৃষ্টি হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল বয়ে আনতে পারে। পরিবেশের ভারসাম্য এবং স্থানীয় প্রাণীজগতের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তা এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের সময় সতর্কতার সঙ্গে বিচার না করার ফলে হয়েছে। এখন এটি প্রশ্ন উঠছে, কতটা পরিবেশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল, এবং ভবিষ্যতে এর থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ
১. সংরক্ষিত বনভূমির ওপর বিপদ
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের জন্য ১০৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথের ২৭ কিলোমিটার অংশ সংরক্ষিত বনভূমির মধ্য দিয়ে গেছে। এতে চুনতি, ফাঁসিয়াখালী ও মেধাকচ্ছপিয়া সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে রেললাইন স্থাপন করা হয়, যেখানে প্রায় ২০৭ একর বনভূমি সংরক্ষিত বন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এটি পরিবেশ সংরক্ষণনীতির প্রতি এক ধরনের উপেক্ষা হিসেবে দেখা যায়। বনভূমি এবং গাছপালা কাটার ফলে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক বাসস্থান হারিয়েছে, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বনভূমির সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ
প্রকল্পের বাস্তবায়নে কাঠামোগত এবং পরিবেশগত ব্যতিক্রমের বিষয়গুলির দিকে নজর দেওয়া হয়নি, যেমন—বনভূমি কাটার কারণে কার্বন শোষণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা এবং মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি। এর ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ছে, যা স্থানীয় জলবায়ুকে আরও বেশি অস্থির করতে পারে।
২. বন্যপ্রাণীর চলাচলে প্রতিবন্ধকতা
এই প্রকল্পের ফলে সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হয়েছে বন্যপ্রাণী, বিশেষত এশিয়ান হাতির জন্য। সংরক্ষিত বনের মধ্যে রেলপথ নির্মাণের ফলে হাতিদের চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, যেটি তাদের অভ্যন্তরীণ জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ান হাতি একটি বিপন্ন প্রজাতি, এবং তাদের সুরক্ষিত চলাচলের জন্য প্রকল্পের পরিকল্পনায় বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
প্রকল্পের অনুমোদনকালে বন বিভাগের পক্ষ থেকে বিশেষ শর্ত ছিল—বন্যপ্রাণীর নিরাপদ চলাচলের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে শুধুমাত্র একটি ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে, এবং দুটি আন্ডারপাস সঠিকভাবে নির্মাণ করা হয়নি, যার ফলে হাতির চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে একটি আন্ডারপাস এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, হাতি সেখানে চলাচল করতে পারে না। ফলে হাতির সাথে ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, যা ইতিমধ্যেই একটি বাচ্চা হাতির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. পরিবেশগত ক্ষতিপূরণের অভাব
পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের সময় বন বিভাগ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল বনভূমি ক্ষতিপূরণ, গাছ রোপণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রম। শর্ত অনুসারে, প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার গাছ রোপণের কথা ছিল, কিন্তু বর্তমানে বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ৬ লাখ ২০ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে, এবং তাও পর্যাপ্ত নয়। উপরন্তু, যে ধরনের গাছ লাগানো হয়েছে, তা বন বিভাগের মত অনুযায়ী পরিবেশের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে প্রকৃত ক্ষতিপূরণের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি, যা প্রকল্পের পরিবেশগত ক্ষতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
৪. ভূমিধসের ঝুঁকি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের নির্মাণ কাজের জন্য পাহাড় কেটে সমতল করা হয়েছিল। এতে পাহাড়ের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছে, যা ভারী বর্ষণে ভূমিধসের ঝুঁকি তৈরি করেছে। ২০২৩ সালের বর্ষায় কক্সবাজার অঞ্চলে একাধিকবার পাহাড় ধসে পড়েছে, যার ফলে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল এবং অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগও বিঘ্নিত হয়েছে। পাহাড়ধসের এই সমস্যা শুধুমাত্র ট্রেন চলাচলকেই বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং স্থানীয় জনজীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি আবার প্রমাণ করে যে, প্রকল্পটির পরিবেশগত মূল্যায়ন যথাযথ হয়নি এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্ভাবনা বাদ দেওয়া যায়নি।
৫. সরকারের দায়িত্ব ও ভবিষ্যত শিক্ষা
সরকারের দায়িত্ব ছিল এই প্রকল্পটির পরিবেশগত প্রভাব এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু বাস্তবতায়, পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক শর্তাবলী ও সতর্কতাগুলি ঠিকমতো পূর্ণ হয়নি, এবং প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরকারের উচিত ছিল প্রকল্পের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান আরও কঠোরভাবে করা।
এখন এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে, তা শুধুমাত্র এই অঞ্চলের জন্য নয়, সারা দেশের জন্য একটি বড়ো শিক্ষা হতে পারে। ভবিষ্যতে, যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, যেন সেগুলি জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে।
উপসংহার
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প একটি উন্নয়ন প্রকল্প হলেও, এটি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। প্রকল্পটির পরিবেশগত মূল্যায়ন এবং বাস্তবায়ন আরও ভালোভাবে করা হলে হয়তো এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেকটা কমানো সম্ভব ছিল। বর্তমানে, একে একে সমস্যা উত্থিত হচ্ছে, বিশেষত পরিবেশের ক্ষতি, বন্যপ্রাণীর ক্ষতি এবং ভূমিধসের ঝুঁকি—এগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
Call-to-Action: আপনি কি মনে করেন, পরিবেশ রক্ষায় আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? আপনার মতামত জানাতে মন্তব্য করুন বা আমাদের পোস্টটি শেয়ার করুন!