26.5 C
Bangladesh
রবিবার, জুন ২২, ২০২৫
spot_img

মশার কামড়ে ঢাকার মানুষ অতিষ্ঠ: কবে নাগাদ সমাধান আসবে?

এক সময়ে, ”মশা ভন ভন করে রে, মশা ভন ভন করে, রাজার বাড়ির মশা এলো গরিবের ঘরে”—এই গানটি আমাদের মনে গেঁথে গিয়েছিল। তবে বাস্তবতা বর্তমানে অনেকটাই বদলে গেছে। আজকাল ঢাকার শহরে, গরিবের ঘর তো দূরের কথা, রাজাও মশার কামড় থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না।

এডিস মশা, কিউলেক্স মশা—এসবের উপদ্রবে রাজধানী এখন একেবারে অতিষ্ঠ। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত মশার কামড় খেতে খেতে সবার জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।

মশা ও ডেঙ্গুর মহামারী

২০২৪ সালে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এই রোগে, আর এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। গত বছর প্রায় ৬০০ মানুষ ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকা।

এডিস মশা কখনো একটু কমে এলেও, কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় এই মশা নিয়ন্ত্রণের অবস্থা এমন যে, তা একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

মশা নিধনের উদ্যোগ: কোনো সুফল মিলছে না?

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি) মশা নিধনের জন্য বিশাল অংকের অর্থ বরাদ্দ করলেও তেমন কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কিউলেক্স মশার কামড়ে একদিকে যেখানে নগরবাসী অতিষ্ঠ, সেখানে মশক নিধন কার্যক্রম ব্যর্থতার দিকে চলে গেছে।

বিভিন্ন এলাকাতে মশার উপদ্রব বেড়েছে, এমনকি হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের দশতলায়ও মশার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একসময় নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো হত, কিন্তু বর্তমানে সিটি করপোরেশনগুলোর মশক নিধন কার্যক্রমে কোনো গতি নেই। ফলস্বরূপ, বাসাবাড়ি এখন মশার কামড়ে আক্রান্ত এবং মশারি ছাড়া বাঁচা যাচ্ছে না।

কিউলেক্স মশা এবং তার নিয়ন্ত্রণ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাব এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে শীতকালেও এর উপস্থিতি বেড়েছে, যা আগামী মার্চ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। পরিবেশবিদরা জানান, এখন সময় এসেছে সিটি করপোরেশনগুলোকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মতো কিউলেক্স মশাও নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন, নইলে এর থেকে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ে পড়তে পারে।

নাগরিকদের অভিযোগ এবং সমাধান

নগরবাসীরা অভিযোগ করছেন, মশক নিধন কার্যক্রমের সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না। একটি বহুতল ভবনের বাসিন্দা বাবর আলী জানিয়েছেন, পাঁচতলা পর্যন্ত মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে, যার কারণে মশারি ছাড়া থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

বিশেষ করে সন্ধ্যার সময় মশার উৎপাত এমন বেড়ে গেছে, যে কেউই নিরাপদ অনুভব করছেন না। এছাড়া, ডিএনসিসির দায়িত্বহীনতার কারণে বর্তমানে মশা নিয়ন্ত্রণের কোনও কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিম ঢাকা পর্যন্ত প্রতিটি এলাকায় মশার উপদ্রব বাড়ছে এবং নাগরিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

সম্ভাব্য সমাধান এবং প্রস্তাবনা

১. মশক নিধন কার্যক্রমে আরো কার্যকরী পদক্ষেপ: ঢাকা শহরের মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সিটি করপোরেশনগুলোর কার্যক্রমে অদৃশ্য মনোযোগ। প্রতিদিন প্রায় লক্ষ লক্ষ টাকা মশক নিধনে বরাদ্দ হলেও, অনেক সময় কার্যক্রম একেবারে অকার্যকর হয়ে পড়ে।

সিটি করপোরেশনগুলোর উচিত নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম চালানো, বিশেষ করে শহরের সর্বত্র এমনকি হাইরাইজ ভবনগুলিতেও। বৃষ্টির মৌসুমে যে খাল, বিল, ডোবা ও নালাগুলোর জন্য মশার বিস্তার হয়, সেগুলো পরিষ্কার করার ব্যবস্থা আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। সিটি করপোরেশনগুলোকে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মশা নিধনে আরো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

২. বাড়ি বাড়ি সচেতনতা এবং ক্যাম্পেইন চালানো:

ডেঙ্গু এবং কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মশা বংশবিস্তার রোধে জনগণকে সচেতন করতে হবে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, বিশেষ করে যেখানে মশার উপদ্রব বেশি, সেখানে বাসা-বাড়ি, স্কুল, অফিস–এর মধ্যে মশা নিধনে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

সিটি করপোরেশনগুলোর উচিত ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে, যেমন বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশক নিধনের উপকরণ দেওয়া এবং সঠিক পদক্ষেপ সম্পর্কে নাগরিকদের জানানো। এটি জনগণকে নিজের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতি আগ্রহী করবে।

৩. কীটনাশকের ব্যবহার এবং আধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ:

ডেঙ্গু ও কিউলেক্স মশার সংক্রমণ কমাতে হলে মশক নিধনে নতুন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে যা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। সিটি করপোরেশনগুলো যদি নিয়মিত প্রযুক্তির মাধ্যমে মশার অবস্থান শনাক্ত করে তবেই মশা নিধন কার্যক্রম কার্যকরী হবে।

বিশেষজ্ঞরা মশার লার্ভা ধ্বংসের জন্য অনেক নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন, সেগুলোর ব্যবহার শুরু করলে ফলাফল দ্রুত আসতে পারে। ফগার মেশিন, হুইল মেশিনের ব্যবহার বাড়ানো এবং কার্যকরী কীটনাশক ছড়ানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৪. নিয়মিত মশক নিয়ন্ত্রণ টিম গঠন:

ঢাকার বিভিন্ন সেক্টরে বিশেষ মশক নিয়ন্ত্রণ টিম গঠন করা জরুরি। বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন নিয়মিতভাবে মশা নিধন কর্মসূচি চালানো উচিত, বিশেষ করে পরিত্যক্ত পণ্যগুলোর প্রতি নজর দিয়ে।

একই সাথে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ত করে তাদের তদারকি বাড়ানো গেলে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও কার্যকর হবে। আরও বিশেষ কার্যক্রম, যেমন মশার লার্ভা নিষ্ক্রিয় করার টিম তৈরি করাও সহায়ক হতে পারে।

৫. শহরের খাল ও জলাশয় পরিষ্কার করা:

ঢাকায় অনেক খাল, ঝিল, বিল ও ডোবা রয়েছে যা মশার বংশবিস্তার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব স্থানে পানির স্তর কমানো, অতিরিক্ত জলাভূমির মধ্যে জল সরবরাহের ব্যবস্থা ও সেগুলোর নিয়মিত পরিষ্কার করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। মশার বিস্তার রোধে এই প্রাকৃতিক জলাশয় পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৬. ডেঙ্গু ও মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়:

মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম যদি কেবল সরকারি উদ্যোগ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। বেসরকারি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে নগর পরিবহন, আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় মশক নিধন কর্মসূচি পরিচালনায় বেসরকারি সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।

শেষ কথা

রাজধানীতে মশার উপদ্রব নতুন কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ। জনগণের ক্ষোভ এবং সিটি করপোরেশনগুলোর দায়িত্বহীনতার কারণে মশা নিধনের কার্যক্রম ঝুলে গেছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ঢাকার বাসিন্দারা আরেকটি স্বাস্থ্য সংকটের মুখে পড়তে পারেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ