বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত এবং এর প্রভাব প্রতিদিন বাড়ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে, ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশে চরম আবহাওয়া পরিস্থিতি এবং জলবায়ু সংকটের ফলে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ শিশু তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে বাধা পেয়েছে। ইউনিসেফের সদ্য প্রকাশিত লার্নিং ইন্টারাপটেড: গ্লোবাল স্ন্যাপশট অব ক্লাইমেট-রিলেটেড স্কুল ডিসরাপশন ইন ২০২৪ শীর্ষক রিপোর্টে এ চিত্র উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনটি জলবায়ু সংকটের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিশাল প্রভাব ফেলছে, তা সবার সামনে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশে ২০২৪ সালে জলবায়ু সংকট
জলবায়ু সংকটের ভয়াবহ প্রভাব: বাংলাদেশের শিশুদের শিক্ষা
বাংলাদেশ, যা দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ, সেখানে জলবায়ু সংকটের প্রভাব বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ইউনিসেফের বিশ্লেষণ অনুসারে, তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং খরার মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং শিশুদের স্কুল কার্যক্রম থমকে যায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় শিকার।
২০২৪ সালে এপ্রিল ও মে মাসে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে অনেক শিক্ষার্থী পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) এবং হিটস্ট্রোকের ঝুঁকিতে পড়েছিল। এতে বাধ্য হয়ে স্কুলগুলো বন্ধ করে দিতে হয়। আরও খারাপ অবস্থা হয় মে মাসে যখন ঘূর্ণিঝড় রেমাল দেশজুড়ে তাণ্ডব সৃষ্টি করে, যার ফলে অনেক অঞ্চলে স্কুলের কার্যক্রম আবারও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জুনে শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা, যা শুধু মানুষকেই নয়, বরং শিশুদেরও শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশে ২০২৪ সালে জলবায়ু সংকট
সিলেট এবং অন্যান্য অঞ্চলের অবস্থা
সিলেট অঞ্চলে বন্যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল। এখানে প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়েছে। আর খুলনা, চট্টগ্রাম, রংপুরের মতো অঞ্চলগুলোতে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত স্কুল বন্ধ ছিল, যার ফলে অনেক শিশুই শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়েছে। এই বন্যার ফলে বাংলাদেশের প্রায় ৭০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের জন্য ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শিখন দারিদ্র্য এবং শিশু বিবাহের ঝুঁকি
বাংলাদেশে জলবায়ু সংকটের সঙ্গে আরও একটি বড় সমস্যা হলো শিখন দারিদ্র্য। ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশের স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে প্রতি দুজনের একজন তাদের ক্লাস অনুযায়ী পড়াশোনা করতে পারছে না। এছাড়া, প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পরেও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী মৌলিক গণনা বা অঙ্ক করতে সক্ষম নয়। এর পাশাপাশি, অনেক মেধাবী মেয়ে শিশুরা শিখন কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়ছে, এবং বিভিন্ন কারণে শিশুবিবাহের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশুবিবাহ হওয়ার দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। এসব কারণে, শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরণের অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা সমাজের উন্নতির জন্য বড় একটি বাধা।
বাংলাদেশের জলবায়ু ঝুঁকি
ইউনিসেফের চিলড্রেন’স ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচক) অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিশুরা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জলবায়ু সংকটে রয়েছে। পরিবেশগত বিপর্যয় ও চরম আবহাওয়া তাদের জন্য বড় ধরনের শঙ্কার সৃষ্টি করছে। প্রতিবছর জলবায়ু সংকটের কারণে বাংলাদেশে হাজার হাজার শিশুর শিক্ষা ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটছে, যার ফলস্বরূপ শিক্ষার মান আরও নিম্নগামী হচ্ছে।
কি পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে বাংলাদেশে আরও বেশি শিশু শিক্ষা থেকে বাদ পড়বে, যার ফলে দেশের অগ্রগতি থেমে যাবে। জলবায়ু সংকটের মোকাবিলা করতে হলে আমাদের সবাইকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি জাতিসংঘ, বিভিন্ন এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে শিশুর শিক্ষার জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও জলবায়ু সংকটের প্রভাব কমানোর জন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এখন আমাদের উচিত, এই সংকট মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এবং ভবিষ্যতের প্রজন্মের শিক্ষার জন্য একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
এক নজরে:
- ২০২৪ সালে ৩ কোটি ৩০ লাখ শিশুর শিক্ষা ব্যাহত
- ইউনিসেফ রিপোর্টে জলবায়ু সংকটের মারাত্মক প্রভাব
- শিখন দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে
- শিশু বিবাহ বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশে একটি বড় সমস্যা
এখনই সময়, আমরা যদি সকলে একত্রিত না হই, তবে বাংলাদেশ এবং পৃথিবীজুড়ে আগামী প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
