শরীয়তপুরের আংগারিয়া-বুড়িরহাট খাল, যেটি একসময় কৃষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলাধার ছিল, এখন এক ভরাট হয়ে যাওয়া জলপথে পরিণত হয়েছে। চার বছরের মধ্যে খালটি প্রায় ব্যবহৃতই হচ্ছে না এবং কৃষকরা সেচের পানির অভাবে বোরো ফসলের আবাদ করতে পারছেন না। এর ফলে প্রায় ২,০০০ একর জমির ফসলের উৎপাদন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, যা একটি বড় ধরনের কৃষি সংকটের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো? এবং কীভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব?
খালের খনন ও পরবর্তী সমস্যা
২০১৯-২০২০ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আংগারিয়া-বুড়িরহাট খাল খনন করার উদ্যোগ নেয়, যাতে কৃষকদের সেচের পানি সরবরাহে সুবিধা হয়। খালটি কীর্তিনাশা নদী থেকে বুড়িরহাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং এর মাধ্যমে প্রায় ৭.৭ কিলোমিটার এলাকা কৃষিকাজের জন্য জল সরবরাহ করা সম্ভব ছিল। খাল খননের জন্য প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয় এবং কাজটি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পায়। খনন কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর খালটি সেচের পানি সরবরাহের জন্য প্রস্তুত হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। খননের সময় নদীর সংযোগস্থলে সম্পূর্ণ মাটি সরানো হয়নি, যার কারণে নদী থেকে খালে পানি প্রবাহিত হতে পারেনি। এতে খালটির পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং একে একে বাজারের ব্যবসায়ীরা খালের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা ফেলা শুরু করেন, যা খালটি ভরাট করে দেয়। একদিকে যেখানে খালের পানি প্রবাহ না থাকার কারণে কৃষকদের সেচের ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে, অন্যদিকে খালটি আরও দ্রুত ভরাট হতে থাকে, যা পরিবেশগত সংকট তৈরি করেছে।
কৃষকদের জন্য বিপদ
এই খালের পানি সরবরাহের উপর নির্ভরশীল কৃষকরা বর্তমানে সেচের পানির জন্য মারাত্মক সমস্যায় পড়েছেন। বিশেষ করে রুদ্রকর ইউনিয়নের সোনামুখী আদর্শ ইরি খামার, যেখানে প্রায় ৪৫০ একর জমিতে বছরে ৮৫০ থেকে ৯০০ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদন হয়, তারা এখন তাদের ফসলের আবাদ করতে পারছেন না। খালটির পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের জমিতে পানি পৌঁছাচ্ছে না এবং তাদের কৃষি কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।
বাজারে ব্যবসায়ীদের জন্যও একই সমস্যা রয়েছে। আংগারিয়া বাজারের ব্যবসায়ীরা ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য একমাত্র জায়গা হিসেবে খালটিকে ব্যবহার করে আসছেন, কারণ তাদের জন্য আবর্জনা ফেলার অন্য কোন জায়গা নেই। এই অবস্থা খালটির অবস্থা আরও খারাপ করে দিচ্ছে এবং মাটি জমে ভরাট হওয়ার কারণে খালের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে খালটি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যাবে।
পরিবেশগত প্রভাব
আংগারিয়া-বুড়িরহাট খালের অবস্থা কেবল কৃষকদের জন্যই নয়, বরং পুরো এলাকার পরিবেশের জন্য একটি বড় সংকট তৈরি করেছে। এই খালটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাধার ছিল, যেখানে জলজ প্রাণী ও বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদের জীবন-যাপন চলত। কিন্তু এখন এই খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেই জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের বাসস্থানের সংকট তৈরি হয়েছে। খালের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পাবে, কারণ এই ধরনের জলাশয়গুলো স্থানীয় জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের ভূমিকা
এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার একটি বড় কারণ হলো আংগারিয়া বাজারের ব্যবসায়ীরা খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলেছেন এবং স্থানীয় প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ নেননি। ব্যবসায়ীদের ময়লা ফেলা বন্ধ করতে প্রশাসন কোনও কঠোর পদক্ষেপ নেননি, যার ফলে খালের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। প্রশাসন যদি ব্যবসায়ীদের ময়লা ফেলা বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতেন এবং খালের পুনঃখনন করার উদ্যোগ নিতেন, তবে এই পরিস্থিতি অনেকটা এড়ানো যেত। এখন সময় এসেছে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার, না হলে খালটি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যাবে।
সমাধানের সম্ভাবনা: কীভাবে আংগারিয়া-বুড়িরহাট খাল পুনরুদ্ধার করা সম্ভব?
আংগারিয়া-বুড়িরহাট খালটি বর্তমানে যে সংকটের মধ্যে পড়েছে, তার সমাধান সম্ভব হলেও এর জন্য একাধিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই সংকটের সমাধান শুধুমাত্র খালটির পুনঃখননেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং একসঙ্গে পরিবেশগত, কৃষি এবং প্রশাসনিক পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এখানে এমন কিছু সমাধানের প্রস্তাব দেওয়া হল, যা এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর হতে পারে।
১. খালের পুনঃখনন এবং পানি প্রবাহের পুনরুদ্ধার
প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, খালের পানি প্রবাহ পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি। খননের সময় কীর্তিনাশা নদীর সংযোগস্থলের মাটি যথাযথভাবে সরানো হয়নি, যার ফলে খালে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এটি পুনরায় খনন করা হলে নদী থেকে পানি প্রবাহিত হতে শুরু করবে এবং খালের পানি সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। এই খনন কাজটি সম্পন্ন করতে বিশেষজ্ঞ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা প্রয়োজন হবে, যারা স্থানীয় সমস্যাগুলোর প্রতি সজাগ থাকবে এবং সঠিকভাবে কাজ সম্পাদন করবে। খালের পানিপ্রবাহ পুনরুদ্ধার করলে কৃষকদের সেচের সমস্যা মিটবে এবং বোরো ধানের আবাদ সম্ভব হবে।
২. ময়লা ফেলা বন্ধ করার কঠোর ব্যবস্থা
খালের বর্তমান সংকটের একটি বড় কারণ হলো আংগারিয়া বাজারের ব্যবসায়ীরা খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে খালের অবস্থার আরও অবনতি হবে। তাই, স্থানীয় প্রশাসনকে ময়লা-আবর্জনা ফেলার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যবসায়ীদের জন্য পরিবেশবান্ধব আবর্জনা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা জরুরি। এক্ষেত্রে, পৌরসভা এবং জেলা প্রশাসনকে ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট স্থান এবং নিয়মাবলি নির্ধারণ করতে হবে। যদি স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আবর্জনা খালে না ফেলতে পারেন, তবে খালের ভরাট হওয়া বন্ধ হবে এবং তার পানি প্রবাহ পুনরুদ্ধার হবে।
৩. কৃষকদের সহায়তায় নতুন সেচ ব্যবস্থা
খালের পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কৃষকরা সেচের পানির জন্য সমস্যায় পড়েছেন। যেহেতু এই খালটি কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাধার ছিল, সেক্ষেত্রে খাল পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি কৃষকদের জন্য বিকল্প সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ। পাম্প স্টেশন বা সেচ পাম্পের মাধ্যমে কৃষকদের সেচের পানি সরবরাহ করা যেতে পারে। এছাড়া, নদী বা খালের জলবায়ু পরিস্থিতি অনুযায়ী, নতুন সেচ ব্যবস্থা স্থাপন করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে, যাতে কোনো খাল বা জলাধার বন্ধ হয়ে গেলে কৃষকদের পানি সংকট না হয়। এমনকি আধুনিক জল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকদের জন্য সেচের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে।
৪. পরিবেশ সচেতনতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ
এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। ব্যবসায়ী, কৃষক, এবং সাধারণ জনগণকে খালের গুরুত্ব এবং তার পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে জানানো প্রয়োজন। পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে আবর্জনা নিষ্পত্তি এবং খালের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা হলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশগ্রহণ করবে এবং পরিবেশ রক্ষা করতে সচেষ্ট হবে। স্থানীয় স্কুল ও কলেজগুলোতে পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কিত কার্যক্রম আয়োজন করা যেতে পারে। এটি শুধু খালের রক্ষা করবে না, বরং পুরো অঞ্চলের পরিবেশের উন্নয়ন করবে।
৫. প্রশাসনিক সমন্বয় এবং পর্যবেক্ষণ
এই ধরনের সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রশাসনিক সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি দপ্তর, পৌরসভা, এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মধ্যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। খালের অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি খাল বা জলাধারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এমন কোনো সমস্যা না ঘটে।
৬. দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
এমন সংকট পুনরাবৃত্তি রোধ করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন। শুধু আংগারিয়া-বুড়িরহাট খাল নয়, পুরো শরীয়তপুর অঞ্চলের অন্যান্য খালেরও এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। তাই, একটি বৃহত্তর জলাধার ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করা উচিত, যার মধ্যে খালের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, পুনঃখনন, এবং পুনর্গঠন করা হবে। পাশাপাশি, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ, সেচ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য দীর্ঘমেয়াদী নীতি তৈরি করা দরকার।
উপসংহার
আংগারিয়া-বুড়িরহাট খালের বর্তমান সংকট একটি সতর্কতা সংকেত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। যদি দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে এই সমস্যাগুলো শুধু কৃষকদের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের পরিবেশের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনবে। তাই স্থানীয় জনগণ, প্রশাসন এবং বিশেষজ্ঞদের একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে, যাতে খালটি পুনরুদ্ধার করা যায় এবং পরিবেশ ও কৃষি পুনরায় সমৃদ্ধ হতে পারে।
এখন আপনার দায়িত্ব! আপনার চিন্তা, মতামত বা অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন নিচে মন্তব্যে।