সিংগাইরের চারিগ্রামে ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার ঘটনা এখন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাতে গোপনে এবং দিনে প্রকাশ্যে এই মাটি কাটার কাজ চালানো হচ্ছে। এতে করে একদিকে এলাকার পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে, অন্যদিকে কৃষিজমি নষ্ট হয়ে মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে। প্রশাসনের সীমিত পদক্ষেপ এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারণে এই অবৈধ কার্যক্রম যেন থামছেই না। ফসলি জমি থেকে চলছে মাটি বিক্রি
ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার ঘটনা
চারিগ্রামের বিস্তীর্ণ তিন ফসলি জমিতে প্রকাশ্যে মাটি কাটার দৃশ্য এলাকাবাসীর কাছে এক পরিচিত চিত্র। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদের দুই সদস্য মো. বশির উদ্দিন ও মো. সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি চক্র এই কাজ চালাচ্ছে। তাদের সঙ্গে ১০-১৫ জনের একটি সিন্ডিকেট যুক্ত, যারা মাটি কাটার পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
প্রতিদিন মাটিকাটা ট্রাক, ভেকু এবং লোকবল দিয়ে চলে জমি ধ্বংসের এই উৎসব। এমনকি সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেলে তাদেরও বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, জমির মালিক ও চক্রের সদস্যরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রশাসনের সীমিত পদক্ষেপ
স্থানীয় প্রশাসন বেশ কয়েকবার মাটি কাটার কাজ বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। চারিগ্রাম ইউনিয়নের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দুইবার অভিযান চালিয়ে কাজ বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার কাজ শুরু হয়। সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী অফিসারও জানিয়েছেন যে, বিষয়টি তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে এই সীমিত পদক্ষেপ মাটি কাটার মতো ভয়াবহ পরিবেশ ধ্বংস রোধে যথেষ্ট নয়। ফসলি জমি থেকে চলছে মাটি বিক্রি
পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব
ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার ফলে দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। জমির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে আশপাশের জমিগুলো ধসে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তিন ফসলি জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেবে। মাটি কাটা এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্যও মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অশনিসংকেত।
কীভাবে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব?
ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার সমস্যার সমাধানে আমাদের প্রয়োজন সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ। প্রথমেই, এই সমস্যার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সেগুলো সমাধানের উপায় বের করতে হবে।
প্রথমত, আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুসারে, ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা বেআইনি। প্রশাসনকে নিয়মিতভাবে নজরদারি এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জরিমানা ছাড়াও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে অন্যরা এই কাজে উৎসাহিত না হয়। ফসলি জমি থেকে চলছে মাটি বিক্রি
দ্বিতীয়ত, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের একার পক্ষে এই সমস্যা পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য স্থানীয় জনগণকে সচেতন করে তাদের সহযোগিতা নিতে হবে। তারা যেন মাটি কাটার বিষয়ে অভিযোগ জানাতে ভয় না পান, সেজন্য একটি নির্ভরযোগ্য অভিযোগ ব্যবস্থা চালু করা উচিত।
তৃতীয়ত, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় জনগণের মধ্যে ফসলি জমির গুরুত্ব ও মাটি কাটার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে প্রচারণা চালানো দরকার। স্কুল, কলেজ এবং কমিউনিটি সেন্টারের মাধ্যমে এই বিষয়ে আলোচনা সভা ও কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে।
চতুর্থত, অল্টারনেটিভ আয়বর্ধক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ফসলি জমির মালিকরা অনেক সময় আর্থিক সংকটের কারণে মাটি বিক্রির পথ বেছে নেন। তাদের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস তৈরি করতে হবে, যেমন কৃষি ঋণ, প্রণোদনা বা সরকারের বিশেষ সহায়তা প্রকল্প।
পঞ্চমত, নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। এই নীতিমালায় জমির সুরক্ষা, উর্বরতা রক্ষা এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা থাকতে হবে।
অবশেষে, পরিবেশবিদদের যুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। তারা এই সমস্যার টেকসই সমাধানে কার্যকর পরামর্শ দিতে পারেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণকে সহায়তা করতে হবে।
এভাবে, সম্মিলিত উদ্যোগ এবং সচেতনতা দিয়ে আমরা ফসলি জমি ধ্বংসের মতো ভয়াবহ সমস্যার সমাধান করতে পারি এবং পরিবেশের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব।
উপসংহার
ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি শুধু একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি মানুষের অর্থনীতি ও জীবিকার জন্যও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আপনার মতামত দিন! আপনার এলাকায় কি এমন ঘটনা ঘটছে? পরিবেশ রক্ষায় আপনার কী পরামর্শ? আপনার অভিজ্ঞতা ও মতামত আমাদের জানান।