শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গাছ কাটা কতটা যৌক্তিক?
একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চত্বরে সম্প্রতি ১৮টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। নতুন ফটক নির্মাণের জন্য নেওয়া এই সিদ্ধান্ত পরিবেশপ্রেমীদের মনে প্রশ্ন তুলেছে—উন্নয়নের নামে গাছ নিধন কি আদৌ গ্রহণযোগ্য? জিলা স্কুলে গাছ কাটা
এর আগে একই প্রতিষ্ঠানে একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য ৫৫টি গাছ কাটা হয়েছিল। দুই দফায় মোট ৭৩টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, এবং ভবিষ্যতে আরও কিছু গাছ কাটার পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। প্রকাশ্য নিলামে এই গাছগুলোর মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ৩৫ হাজার টাকা, যা অবিশ্বাস্যভাবে কম।
এত কম দামে শতবর্ষী গাছ বিক্রির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং সবুজায়ন সংকটের সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এভাবে গাছ কাটা কতটা দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত?
পরিবেশের ক্ষতি কতটা গুরুতর?
গাছ শুধু অক্সিজেন দেয় না, বরং এটি একটি সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো জায়গায় বড় গাছ থাকা মানে শিক্ষার্থীদের জন্য ছায়াযুক্ত পরিবেশ, শীতল বাতাস এবং ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু যখন এমন গাছ কেটে ফেলা হয়—
- তাপমাত্রা বাড়ে: গাছ কমে গেলে এলাকায় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।
- বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায়: গাছ ধুলো ও দূষণ শোষণ করে, যা বাতাসকে বিশুদ্ধ রাখে।
- জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়: পাখি ও অন্যান্য প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়।
- পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়: দীর্ঘমেয়াদে এটি জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, শহরের বিভিন্ন স্থানে উন্নয়নের নামে নির্বিচারে গাছ কাটা এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা কি দীর্ঘমেয়াদে এর ফলাফল ভেবে দেখছি?
উন্নয়ন কি পরিকল্পিতভাবে করা যেত না?
উন্নয়ন প্রয়োজন, তবে সেটি হতে হবে পরিবেশবান্ধব। কিছু বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া যেত—
- গাছ সংরক্ষণ করে পরিকল্পনা: ফটক নির্মাণের জন্য এমন জায়গা নির্ধারণ করা যেত যেখানে কম সংখ্যক গাছ কাটতে হতো।
- গাছ প্রতিস্থাপন: বড় গাছগুলো উপড়ে অন্যত্র রোপণ করা যেত।
- সবুজায়ন প্রকল্প: যদি গাছ কাটা একান্তই জরুরি হয়, তবে দ্বিগুণসংখ্যক নতুন গাছ রোপণের প্রতিশ্রুতি থাকতে পারত।
- শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা: শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে একটি পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা নেওয়া যেত, যা তাদেরও সচেতন করত।
কিন্তু এগুলোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় বাসিন্দা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকে এই গাছ নিধনের বিরোধিতা করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, গাছের ছায়ায় অভিভাবকরা অপেক্ষা করতেন, শিক্ষার্থীরা বিশ্রাম নিতেন। গাছ কেটে ফেলার ফলে এই সুযোগ আর থাকছে না, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে বেশ অসুবিধার সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে গরমে বা বৃষ্টির দিনে, গাছের ছায়া ছিল তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। এমনকি কিছু অভিভাবক অভিযোগ করছেন, গাছ কেটে ফেলার ফলে যে নানান পরিবেশগত ক্ষতি হবে তা তারা ভবিষ্যতে টের পাবেন। জিলা স্কুলে গাছ কাটা
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে ২০০০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, সেখানে গাছের উপস্থিতি শুধু পরিবেশকে নয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এসব গাছ অনেক বছর ধরে ওই এলাকায় অর্ন্তভুক্ত ছিল, এবং তাদের কাটা পরিবেশের ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন: সমস্যা না সমাধান?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গাছ কাটা, কোনো সন্দেহ ছাড়াই, পরিবেশের প্রতি অবহেলার একটি বড় উদাহরণ। তবে এখানে মূল প্রশ্ন হলো, এরকম অপরিকল্পিত উন্নয়ন কেমনভাবে সমাজে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করবে?
পুনরায় বলা যেতে পারে যে, এখানে আরও সতর্কতার সাথে পরিবেশগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার ছিল। যে ধরনের উন্নয়ন করা হয়েছে, তা শুধুমাত্র সময়ের প্রয়োজনে করা হয়েছে, কিন্তু তার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল সম্পর্কে ভাবনা ছিল না। এখন যদি সেই ক্ষতি মেরামত না করা হয়, তবে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যাগুলোর পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।
সামাজিক বন বিভাগ ও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব
বন বিভাগের ভূমিকা এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ। গাছ কেটে ফেলতে হলে একটি আইনগত প্রক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু গাছের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কতটা সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন ওঠেছে। বন বিভাগের তরফ থেকে এসব গাছের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তবে এটি কি যথাযথ মূল্যায়ন ছিল? প্রশ্ন হচ্ছে, যদি গাছের দাম কম হয়, তবে তার মানে কি এটি অবমূল্যায়ন, নাকি একেবারেই যথাযথ মূল্যায়ন?
এছাড়া গাছ কাটার আগে কোনো পরিকল্পনা বা ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ সম্পর্কে সমাজকে কেন জানানো হয়নি? এটি কোথায় যেতে পারে, তা জানা গেলে হয়তো স্থানীয়রা অথবা পরিবেশপ্রেমীরা আরও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারতেন।
শেষ কথা: পরিবেশের সুরক্ষায় আরও সচেতনতা প্রয়োজন
বগুড়া জিলা স্কুলে গাছ কাটা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা একে অপরকে দায়ী করার সময় নয়, বরং আমাদের পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীলতা দেখানোর সময়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস কিংবা অন্যান্য এলাকার উন্নয়ন হলে গাছ কাটার প্রয়োজন হতে পারে, তবে সেটা যেন যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে হয়। গাছ কেটে ফেলা হলো একটি সাময়িক সিদ্ধান্ত, তবে তা যদি আরও পরিকল্পিতভাবে না হয়, তবে তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হতে পারে মারাত্মক।
আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, পরিবেশের সুরক্ষা শুধু সরকারের বা কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সকলের দায়িত্ব। পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ থেকেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠবে।
সুতরাং, গাছ কাটা, পরিবেশ রক্ষা এবং উন্নয়নের সঠিক সমন্বয় এখনই সময়ের দাবি।
আপনার মতামত জানাবেন? এই বিষয়ে আপনার কি মতামত? গাছ কাটা কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল, নাকি আরও পরিকল্পিত উন্নয়ন করা যেত? নিচে কমেন্ট করে আপনার মতামত জানিয়ে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করুন।