নদী গিলে খাচ্ছে বসতভিটা, আতঙ্কে মানুষ
ফেনীর সোনাগাজী একসময় কৃষি, নদীপথের বাণিজ্য ও মৎস্য আহরণের জন্য পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন এই জনপদ ধীরে ধীরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদী ভাঙনের প্রকোপ এতটাই বেড়েছে যে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও নতুন করে ভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। শত শত মানুষ বাস্তুহারা হচ্ছে, তাদের বসতভিটা, ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয় সবই ধ্বংসের মুখে। উপকূলে ভয়াবহ নদী ভাঙন
নদী ভাঙনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হলো এর আকস্মিকতা। কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই গভীর রাতে নদী গিলে খাচ্ছে বসতভিটা। অনেকে দিনশেষে ঘুমাতে গেছেন নিজের ঘরে, কিন্তু সকালে জেগে দেখেছেন—তাদের জমি, ঘর, সবকিছু পানির নিচে!
ভাঙনের প্রধান কারণ কী?
এই ভাঙনের পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে:
- নদীর প্রবল স্রোত ও জলবায়ুর পরিবর্তন:
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বর্ষার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পানির তীব্রতা বাড়ছে। ফলে নদীর গতি ও গভীরতা পরিবর্তন হচ্ছে, যা ভাঙনকে আরও ত্বরান্বিত করছে। উপকূলে ভয়াবহ নদী ভাঙন
- নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন ও বাঁধের দুর্বলতা:
বহু বছর ধরে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় ও পরিকল্পনাহীন জল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে নদীর গতি বিপর্যস্ত হয়েছে। ফলে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করছে।
- মুছাপুর রেগুলেটর ধ্বংস ও তার প্রভাব:
২০০৫ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ২০১৮ সালে সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এটি ধসে পড়ে। ভারতীয় বন্যার পানির চাপে এই রেগুলেটর ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই ভাঙন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে নতুন কোনো কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় সোনাগাজীর বিস্তীর্ণ এলাকা ঝুঁকির মুখে।
কোন কোন এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত?
সোনাগাজীর চরদরবেশ, চরচান্দিয়া, চরমজলিশপুর, আমিরাবাদসহ অনেক ইউনিয়নে নদী ভাঙনের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে আলামপুর, পশ্চিম চরচান্দিয়া, সাহেবের ঘাট, চরবদরপুর, কালি মন্দির, বাদামতলী, ইতালি মার্কেট, গুচ্ছগ্রামসহ বহু গ্রাম ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে বা ধ্বংসের মুখে রয়েছে।
এই এলাকাগুলোতে ইতোমধ্যে স্কুল, মসজিদ, ফসলি জমি এবং বসতভিটা নদীগর্ভে চলে গেছে। দিনের পর দিন মানুষজন নিজেদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন, কিন্তু কতদিন এভাবে পালিয়ে বেড়ানো সম্ভব?
মানুষের জীবনযাত্রায় ভয়াবহ প্রভাব
নদী ভাঙন শুধু ভূমি গ্রাস করছে না, এটি মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
- আর্থিক সংকট: জমি হারিয়ে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। কৃষিজীবী ও জেলেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, কারণ তাদের জীবিকার একমাত্র উৎসই নদীর ধারে অবস্থিত ছিল।
- শিক্ষা ও সামাজিক অবকাঠামো: বহু স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ভেঙে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
- বাস্তুহারা মানুষ: অনেক পরিবার তাদের জন্মভিটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
ভাঙন রোধে কি কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে?
এতবড় বিপর্যয়ের পরও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। যদিও প্রশাসন বিভিন্ন আশ্বাস দিয়ে থাকে, তবে বাস্তবিক পদক্ষেপ এখনো অনিশ্চিত। মুছাপুর রেগুলেটরের ধ্বংসের পর নতুন কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়ানক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়।
সমাধানের পথ কী?
- স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ও নদীশাসন প্রকল্প: শুধু সাময়িক বাঁধ তৈরি করলেই চলবে না, টেকসই ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
- জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর নীতি: নদীভাঙনের অন্যতম কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন, তাই আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
- স্থানীয়দের জন্য পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান: ভূমিহীন হয়ে যাওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং বিকল্প জীবিকার পথ খুঁজতে হবে।
শেষ কথা
নদী ভাঙনের ফলে শুধু ভূমি হারাচ্ছে না, একটি জনপদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সোনাগাজীকে রক্ষা করতে হলে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়তো আগামী কয়েক দশকের মধ্যে এটি কেবল ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবে।
📢 আপনার মতামত দিন! আপনার এলাকায় নদী ভাঙনের অবস্থা কেমন? এই সংকট মোকাবিলায় কী করা উচিত বলে মনে করেন? মন্তব্যে জানান এবং সচেতনতা বাড়াতে পোস্টটি শেয়ার করুন! 🌍