28.9 C
Bangladesh
বৃহস্পতিবার, জুলাই ১০, ২০২৫
spot_img

বিলীন হচ্ছে কুতুবদিয়ার প্রকৃতি! কেন হুমকির মুখে দ্বীপের পরিবেশ?

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে কুতুবদিয়া একসময় জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য স্থান ছিল। এখানকার সমুদ্রতীর, বনাঞ্চল, নদী ও খালবিল ছিল হাজারো প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু দিন বদলেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, দূষণ ও অব্যবস্থাপনার কারণে কুতুবদিয়ার পরিবেশ আজ ভয়াবহ সংকটের মুখে। এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে কুতুবদিয়া বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। বিলীন হচ্ছে কুতুবদিয়ার প্রকৃতি

বিলীন হচ্ছে বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য

কুতুবদিয়া উপজেলার ৫৪টি গ্রামের মধ্যে একসময় খুদিয়ারটেক গ্রামটি ছিল প্রচুর বনাঞ্চলে ভরপুর। কিন্তু বর্তমানে বন উজাড়ের ফলে এই গ্রামটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কেবল খুদিয়ারটেকই নয়, উপজেলার উত্তরচর ধূরুংসহ আরও কয়েকটি এলাকায় একসময় গড়ে ওঠা নিবিড় বনায়ন আজ কেবল স্মৃতির অংশ হয়ে গেছে।

বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে এখানকার জীববৈচিত্র্যও। একসময় এই বনাঞ্চলে হাজার হাজার পাখি বাসা বাঁধত, তাদের কিচির-মিচির ডাক প্রকৃতিকে মোহিত করত। কিন্তু বনায়ন ধ্বংস হওয়ায় পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।

বন উজাড়ের ফলে কুতুবদিয়ার জলবায়ুও বদলে যাচ্ছে। তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, এবং খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাছপালা কমে যাওয়ায় মাটির বাঁধন দুর্বল হয়ে পড়ছে, ফলে সমুদ্রের ঢেউ সহজেই ভূমি ক্ষয় করতে পারছে। বিলীন হচ্ছে কুতুবদিয়ার প্রকৃতি

জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কুতুবদিয়া আগামী দশ বছরে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হচ্ছে, আর সেই সঙ্গে চাষাবাদ ও মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী জমি কমে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর (অব.) ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন বলেছেন, কুতুবদিয়ার চারপাশে পর্যাপ্ত বনায়ন না থাকলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা দ্বীপবাসীদের জন্য আরও মারাত্মক হতে পারে।

কুতুবদিয়ার জলবায়ু সংকটের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা ও লবণাক্ততার আধিক্য, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব। প্রতিবছর উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হচ্ছে, যার ফলে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা দ্বীপবাসীদের জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার সংখ্যা বাড়ছে, যা দ্বীপের পরিবেশকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলেছে।

মানবসৃষ্ট কারণ: কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ও দূষণ

কুতুবদিয়ার চারপাশে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রসার দ্বীপের পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। বাঁশখালীর গন্ডামারা ও মহেশখালীর মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বায়ুদূষণের ফলে কুতুবদিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কারণে কুতুবদিয়ার বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বাতাসের প্রবাহের কারণে উত্তর বা দক্ষিণ দিক থেকে আসা দূষিত বাতাস দ্বীপের পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে।

প্লাস্টিক দূষণও কুতুবদিয়ার পরিবেশ ধ্বংসের অন্যতম কারণ। যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার কারণে সমুদ্র ও নদীগুলো মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন বলেছেন, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে, তাই ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বায়ুদূষণের প্রভাব স্পষ্টভাবে অনুভব করছেন। তাদের মতে, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে কুতুবদিয়ার বাতাসের গুণগত মান প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে।

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় করণীয়

বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় বাসিন্দারা কুতুবদিয়ার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রথমত, ক্ষতিগ্রস্ত বনাঞ্চল পুনরুদ্ধার করা জরুরি। নতুন করে বৃক্ষরোপণ এবং উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ বন তৈরির মাধ্যমে পরিবেশগত ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে।

দ্বিতীয়ত, নদী ও সমুদ্র দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য নিষ্পত্তির জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে জলজ পরিবেশ সুরক্ষিত থাকে।

তৃতীয়ত, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন, যাতে তারা পরিবেশের ক্ষতি না করে বরং সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে।

চতুর্থত, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে নজর দিতে হবে। সৌর ও বায়ু শক্তির মতো পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব।

শেষ কথা

কুতুবদিয়া শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন সংকটের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন উজাড়, দূষণ এবং কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে এই দ্বীপের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে কুতুবদিয়াকে আবারও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করে তুলতে।

আপনিও পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারেন। আপনার মতামত ও পরামর্শ জানাতে কমেন্ট করুন। পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে এই তথ্য শেয়ার করুন, যাতে আরও মানুষ কুতুবদিয়ার সংকট সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ