25.7 C
Bangladesh
শুক্রবার, জুলাই ১১, ২০২৫
spot_img

তিস্তার পানি সংকট: কেন মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে উত্তরাঞ্চল?

তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান নদী এবং এর পানি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কৃষি, জীবনযাত্রা এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য। কিন্তু গত কয়েক দশকে, নদীটির প্রবাহের ওপর বিশাল প্রভাব পড়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি নদী নয়, বরং একটি জীবন্ত অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সিস্টেম যা হাজার হাজার মানুষের জীবিকার উৎস। নদীটির ওপর এই বিপর্যয়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে যা আজকের দিনে এই নদীকে “শুষ্ক মরুভূমি”তে পরিণত করেছে। তিস্তার পানি সংকট

তিস্তা নদী: ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ভূমিকা

তিস্তা নদী একসময় দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী ছিল। নদীটি ৩১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ, যার মধ্যে ১৫৮ কিলোমিটার বাংলাদেশের অংশে অবস্থিত। নদীটির পানি দক্ষিণাঞ্চলে জলসেচের কাজ করত, যা প্রায় ৩০ লাখ কৃষককে সরাসরি উপকৃত করত। তিস্তা অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের সভ্যতার অংশ হিসেবে পরিচিত ছিল। নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে কৃষি, মৎস্য চাষ, এবং অন্যান্য জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

তবে আজকাল, নদীর প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার কারণে ঐতিহ্যবাহী এ জীবিকা গুলোর উপর বিপুল প্রভাব পড়েছে।

তিস্তা নদী সংকট: মূল কারণ

১. ভারতীয় পানি ব্যবস্থাপনা

ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গজলডোবা বাঁধের জন্য তিস্তার পানি ভারতীয় অংশে চলে যায়, বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে। এর ফলে, নদীর প্রবাহ কমে যায় এবং নদীটি বাংলাদেশের অংশে শুকিয়ে যায়। বিশেষত, এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত পানি সংকট তীব্র হয়ে ওঠে, যা কৃষির জন্য বিপজ্জনক। তিস্তার পানি সংকট

তিস্তা নদীর ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা সত্ত্বেও, ভারত তিস্তার পানি অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহার করে, এবং শুষ্ক মৌসুমে তার পানির পরিমাণ ভারতে ব্যবহৃত হয়। ফলে, দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টনের জন্য কোনো সঠিক চুক্তি না থাকায় সমস্যাগুলো আরও বেড়েছে। ১৯৯৬ সালে তিস্তা চুক্তি হওয়ার পর, এটি স্থগিত হয়ে পড়ে, ফলে এই সমস্যার সমাধান হয়নি।

২. পানি সংকটের কারণে কৃষির বিপর্যয়

তিস্তার পানি সংকটের কারণে অঞ্চলের কৃষির অভাবনীয় ক্ষতি হচ্ছে। প্রধানত ধান, পাট এবং বিভিন্ন শস্যের ফলন নির্ভর করে নদীর পানি সরবরাহের ওপর। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবের কারণে আবাদি জমি শুকিয়ে যাচ্ছে এবং ফসলের ফলন ব্যাপকভাবে কমছে। নিত্যদিনের খাদ্য সরবরাহ কমে যাওয়ায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।

এছাড়া, মৎস্য চাষও বিপর্যস্ত হচ্ছে। তিস্তা নদী একসময় মৎস্যজীবীদের জীবিকা ছিল, তবে পানির স্তরের কমে যাওয়ার কারণে মাছের প্রজননও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

৩. বন্যা: অপ্রত্যাশিত ফলাফল

যদিও শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটের বিষয়টি স্পষ্ট, বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছাড়ানোর কারণে তিস্তা নদীতে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। গজলডোবা বাঁধে অতিরিক্ত পানি ছাড়ানো হলে তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশে চলে আসে, যা বন্যা সৃষ্টি করে এবং আবাদি জমি ধ্বংস হয়। এই বন্যার ফলে হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি, কৃষি জমি, এবং অন্যান্য সম্পদ হারায়।

তিস্তার ওপর পরিবেশগত প্রভাব: বিস্তারিত বিশ্লেষণ

তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলস্রোত, যা নদীর তীরে বসবাসকারী মানুষের জীবিকা ও পরিবেশের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। নদীটির সংকোচন ও পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে তিস্তার ওপর পরিবেশগত প্রভাব তীব্র হয়েছে, যা শুধু কৃষি, মৎস্যজীবী ও জীবনযাত্রার ওপর নয়, বরং প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্যের ওপরও বিরাট ক্ষতি সাধন করছে।

১. জীববৈচিত্র্য সংকোচন

তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ার ফলে নদীটির তীরে বসবাসকারী জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হচ্ছে। এক সময় নদীটি নানা প্রজাতির মাছ, জলজ উদ্ভিদ, পাখি, এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য একটি সমৃদ্ধ বাসস্থল ছিল। কিন্তু বর্তমানে পানি স্তরের নেমে যাওয়ার কারণে এই সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদসমূহের বাসস্থল সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিশেষত, মাছের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো অনেকটাই শুকিয়ে গেছে, যার ফলে মাছের প্রজাতির সংখ্যা কমে গেছে।

এছাড়া, নদীর তীরে বসবাসকারী বিভিন্ন ধরনের পাখি, বিশেষত জলপাখি, তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল হারিয়েছে। ফলে, এই জীববৈচিত্র্যও ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

২. ভূগর্ভস্থ পানি স্তরের অবনতি

তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে, নদীটি যে এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বজায় রাখত, সেটি এখন অনেকটাই নিচে নেমে গেছে। এই অবস্থা দীর্ঘমেয়াদী জলসম্পদের সংকট সৃষ্টি করবে। সেচ ও পানি সরবরাহের জন্য স্থানীয় জনগণ এবং কৃষকরা অনেক ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে পানির সংকট আরও তীব্র হবে।

৩. মাটি শুকানো ও মরুকরণ

শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে ফেলার কারণে, নদীর তীরে থাকা মাটি শুকিয়ে গিয়ে মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই শুকিয়ে যাওয়া মাটি কৃষি জমি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। মাটি ক্ষয়প্রবণ হয়ে ওঠে, যা কৃষিকাজের জন্য অপ্রতুল হয়ে যায় এবং জমির উর্বরা শক্তি কমে যায়।

৪. আবহাওয়া পরিবর্তন ও বন্যা

ভারতীয় গজলডোবা ব্যারাজের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যায়, তবে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছাড়া হয়, যা বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টি করে। এই অতিরিক্ত পানি নদীর তীরে থাকা বসবাসের জায়গাগুলিতে প্রবাহিত হয়ে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করে। বন্যার কারণে কৃষি জমি, ঘর-বাড়ি এবং জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৫. মৎস্যজীবীদের ক্ষতি

তিস্তা নদী একসময় একটি বড় মৎস্যজীবী অঞ্চল ছিল। নদীর পানি কমে যাওয়ার ফলে মৎস্যজীবীরা তাদের জীবিকা হারাচ্ছেন। মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে মৎস্যজীবীদের আয়ও অনেক কমে গেছে, যা একদিকে তাদের জীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করছে, অন্যদিকে খাদ্য সরবরাহেও অভাব দেখা দিচ্ছে।

তিস্তা নদী সংকটের সমাধানের প্রস্তাব: বিস্তারিত পরিকল্পনা

তিস্তা নদী পুনঃপ্রবাহিত ও সংরক্ষিত করার জন্য একাধিক সমাধান প্রস্তাবিত হতে পারে, যা নদীটির পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে সহায়ক হবে। এখানে কিছু প্রধান সমাধান:

১. দ্বিপাক্ষিক পানি বণ্টন চুক্তি (India-Bangladesh Water Sharing Agreement)

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে তিস্তার পানি শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্তভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়, যার ফলে বাংলাদেশে পানির সংকট সৃষ্টি হয়। এই কারণে, একটি স্থায়ী ও সমন্বিত পানি বণ্টন চুক্তি প্রয়োজন যাতে উভয় দেশ নির্ধারিত পরিমাণ পানি নিশ্চিতভাবে পায়। তিস্তা চুক্তির পুনরুজ্জীবন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য দুই দেশের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজন।

২. সেচ ব্যবস্থাপনা ও পানি পুনঃব্যবহার

তিস্তার পানি সেচ ব্যবস্থাপনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এর প্রভাব প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ওপর পড়ছে। সেচ ব্যবস্থার পুনঃপরিকল্পনা, যেমন জলাধার তৈরি, প্রাকৃতিক জলস্রোত সংরক্ষণ, এবং ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে তিস্তার পানি ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। কৃষকদের জন্য পানি ব্যবস্থাপনার কার্যকরী প্রশিক্ষণ এবং তাদের কাছে উন্নত সেচ প্রযুক্তি সরবরাহ করা প্রয়োজন।

৩. পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধার প্রকল্প

তিস্তা নদীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য নদী তীরবর্তী এলাকার বনাঞ্চল ও জলাশয় পুনরুদ্ধার করা জরুরি। এখানে বৃক্ষরোপণ এবং জলাভূমি সংরক্ষণ কার্যক্রম চালানো হতে পারে, যা নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

৪. ভূগর্ভস্থ পানি পুনঃস্থাপন উদ্যোগ

তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে। এই কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে, যেমন পানি সঞ্চয়, জলাধার নির্মাণ, এবং ভূপৃষ্ঠের পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তি উন্নয়ন।

৫. অবস্থানগত পুনর্বাসন এবং বিকল্প জীবিকা

তিস্তা নদীর পানি সংকটের কারণে তীরবর্তী কৃষক ও মৎস্যজীবীদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা উচিত। এখানকার জনগণের জন্য মৎস্য চাষের পাশাপাশি পর্যটন শিল্প, কৃষি প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার সহ বিভিন্ন বিকল্প জীবিকার উৎস তৈরি করা যেতে পারে।

৬. জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও সহনশীলতা

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তিস্তা নদীর ওপর আরও চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। নদীটির পানি সরবরাহ পুনরুদ্ধারের জন্য এবং বন্যা ও খরা মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত জলবায়ু অভিযোজন কৌশল গ্রহণ করা জরুরি। এতে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।

উপসংহার

তিস্তা নদী বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলস্রোত, যার ওপর শোষণ এবং মানবিক কার্যক্রমের কারণে বর্তমানে বিপর্যয় ঘটছে। নদীটির শুষ্কতা এবং পানির অভাব শুধুমাত্র বাংলাদেশের কৃষি নয়, সমগ্র পরিবেশ এবং মানুষের জীবনযাত্রার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সুষ্ঠু পানি বণ্টন চুক্তি, পরিবেশ সংরক্ষণ, এবং নদীর পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের মাধ্যমে তিস্তার পুনর্জন্ম সম্ভব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ