প্রতিবছর দুর্যোগে ক্ষতি তিন হাজার কোটি ডলার: একটি বৈশ্বিক সংকট
দুর্যোগের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, এবং এর ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশ বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বন্যা, খরা, ঝড় এবং তাপপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর তিন হাজার কোটি ডলার বা প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি সাধন করছে। পাশাপাশি এসব দুর্যোগে প্রতিবছর ৬৩ লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অগ্রগতি
আজকের এই বিশ্লেষণ পোস্টে, আমরা আলোচনা করবো কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর ফলে মানবিক সংকট কেমন রূপ নিচ্ছে এবং কীভাবে পৃথিবীকে রক্ষা করা সম্ভব।
বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ এবং তার ক্ষতি
জার্মানওয়াচের ‘ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০২৫’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯,৪০০টিরও বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে, যার ফলে ৮ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং মোট অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৪.২ ট্রিলিয়ন ডলার। এসব দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ৩১ নম্বরে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং খরা দ্বারা, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ফলস্বরূপ। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অগ্রগতি
বাংলাদেশে দুর্যোগের প্রকৃতি
২০১২ থেকে ২০২2 পর্যন্ত বাংলাদেশে চরম আবহাওয়া সম্পর্কিত ৮টি বড় ধরনের দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে, মারাত্মক তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা হয়েছে, যা শুধু মানুষের জীবনই বিপন্ন করেনি, বরং দেশের কৃষি, শিল্প এবং অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের মার্চ-মে মাসে পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশে একযোগভাবে তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে ৯০ জনেরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া, একই সময়ে দেশগুলোতে ঘটে গিয়েছিল ভয়াবহ বন্যা, যা খরায় আক্রান্ত কৃষক ও পরিবারের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর ছিল।
অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রা
বাংলাদেশের দুর্যোগের অর্থনৈতিক ক্ষতি ব্যাপক, প্রতি বছর এই ক্ষতি প্রায় ৩ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। একটি উদাহরণ হিসেবে, ২০২০ সালের বন্যা বাংলাদেশে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি সাধন করেছে। আরেকটি বড় উদাহরণ হতে পারে ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর, যার ফলে ক্ষতির পরিমাণ 2.3 বিলিয়ন ডলার ছিল।
এই ক্ষতির ফলে স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থা, কৃষি খাত এবং অবকাঠামো প্রকল্পগুলি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যবসা এবং আমদানি কার্যক্রমে এর প্রভাব পড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে। জার্মানওয়াচের আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতির প্রধান লরা শেফার বলছেন, জলবায়ু সংকট একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকি হয়ে উঠেছে। যা বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোকেও গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলা করতে বাধ্য করছে।
বিশ্বের জলবায়ু সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট ধীরগতি থাকলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক এবং মানবিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। সেই দিক থেকে, বিশেষত বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অতিরিক্ত অর্থায়ন জরুরি।
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: এক অগ্রগতি কাহিনী
যদিও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে, তবে দেশটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং অভিযোজন পরিকল্পনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত ৪০ বছরে, ঘূর্ণিঝড়জনিত মৃত্যুহার ১০০ গুণ কমেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭০ সালে একটি ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, অথচ ২০০৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৩৪ জনে।
বাংলাদেশের এই সফলতা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে এবং এটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য একটি মডেল হয়ে উঠেছে।
কী করা উচিত?
জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশসহ পৃথিবীজুড়ে শক্তিশালী জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও অভিযোজনের কৌশল গ্রহণ করা জরুরি।
- উন্নত জলবায়ু অর্থায়ন: উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অতিরিক্ত অর্থায়ন এবং প্রণোদনার প্রয়োজন, যাতে তারা তাদের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।
- প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: চরম আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং কার্যকর প্রস্তুতি ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
- জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন পরিকল্পনা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিরোধে আরও শক্তিশালী জাতীয় পরিকল্পনা প্রয়োজন।
শেষ কথা: একসাথে কাজ করার সময়
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের এই চরম ঝুঁকিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন। বাংলাদেশ তার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এক অগ্রগতি দেখালেও, অন্য দেশগুলোও সঙ্গ দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মোকাবিলায়। সময় থাকতে সচেতন হতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতির সম্মুখীন না হতে হয়।
আপনার মতামত শেয়ার করুন: আপনি কী মনে করেন, কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?