29.6 C
Bangladesh
সোমবার, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৫
spot_img

রংপুরে কৃষিজমির উর্বর মাটি ইটভাটায় বিক্রি: কৃষি ও পরিবেশের জন্য বড় হুমকি

কৃষিজমির মাটি বিক্রি: সমস্যার শুরু কোথায়?

রংপুরের বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলায় ইটভাটাগুলোর চাহিদা মেটাতে কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানীয় কৃষকরা নগদ অর্থের লোভে জমির উর্বর মাটি সরবরাহ করছেন, যদিও তারা বুঝতে পারছেন না এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মাটির স্তরেই সবচেয়ে বেশি জৈব পদার্থ থাকে, যা ফসল উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য। অথচ কৃষকদের আর্থিক সংকট এবং বাজারে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তারা জমির ভবিষ্যৎ উর্বরতা নিয়ে না ভেবে নগদ অর্থের দিকে ঝুঁকছেন। উর্বর মাটি ইটভাটায় বিক্রি

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইটভাটার মালিকরা কৃষকদের কাছ থেকে জমির মাটি কিনে ট্রাক্টরে করে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছেন। বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ মিলিয়ে অন্তত ৮৩টি ইটভাটা সক্রিয় রয়েছে, যেখানে অধিকাংশের বৈধ কাগজপত্র নেই। একবার এই মাটি তুলে নেওয়া হলে জমির উর্বরতা ফেরত আসতে ১৫-২০ বছর সময় লেগে যায়, যা কৃষির জন্য ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

কৃষকদের আর্থিক সংকট ও মাটি বিক্রির মূল কারণ

অনেক কৃষকই জানেন না যে জমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি করা ভবিষ্যতে তাদের জন্য আরও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু তাদের প্রধান সমস্যা অর্থনৈতিক সংকট। ফসল উৎপাদন করেও তারা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। বিশেষ করে আলু ও সবজির দরপতন কৃষকদের জন্য আরও বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

অনেক কৃষক অভিযোগ করেছেন যে ১০০ টাকা কেজি দরে আলুবীজ কেনার পর সেই আলু তারা বিক্রি করছেন মাত্র ১০ টাকায়। একইভাবে সবজি চাষেও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তারা। এত লোকসানের মুখে পড়ে জমির মাটি বিক্রি করে সাময়িকভাবে কিছু টাকা হাতে পাওয়াই তাদের কাছে উত্তরণের পথ বলে মনে হচ্ছে। একজন কৃষক বলেন, “বাধ্য হয়ে জমির মাটি বিক্রি করছি। এক গাড়ি মাটির দাম পাই ৩০০ টাকা। সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে।” উর্বর মাটি ইটভাটায় বিক্রি

ইটভাটাগুলোর অনিয়ম ও প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা

বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জের ইটভাটাগুলোর বেশিরভাগই অবৈধভাবে চলছে। বদরগঞ্জে ৭১টি ইটভাটার মধ্যে ৫১টির বৈধ কাগজপত্র নেই, আর তারাগঞ্জে ২২টি ইটভাটার মধ্যে ১৯টি অবৈধ। এসব ইটভাটায় প্রতিবছর ৫০ থেকে ৮০ লাখ কাঁচা ইট পোড়ানো হয়, যার জন্য প্রচুর পরিমাণে মাটি প্রয়োজন হয়। ইটভাটা মালিকেরা কম দামে কৃষকদের কাছ থেকে এই মাটি কিনছেন, আর কৃষকেরাও অভাবের কারণে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। একজন ইটভাটা মালিক স্পষ্ট করেই বলেন, “ইট তৈরিতে প্রচুর মাটি লাগে, আমরা যেখানে পাই, সেখান থেকে কিনে নেই।” ফলে দেখা যাচ্ছে, একদিকে আইন আছে, কিন্তু এর কার্যকর প্রয়োগ নেই।

মাটি বিক্রির ফলে কৃষি ও পরিবেশের ক্ষতি

কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি হারালে জমির উর্বরতা কমে যায়, ফলে ফসল উৎপাদন কমে আসে। আগে যেখানে ধান, সবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদিত হতো, সেখানে এখন চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। নিচু হয়ে যাওয়া জমিগুলো সহজেই জলাবদ্ধ হয়ে যায়, ফলে বন্যার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।

একজন কৃষি কর্মকর্তা জানান, “জমির উর্বরতা নষ্ট হলে ফসল উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে, যা ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে।” এ ছাড়াও, ইটভাটার কারণে বায়ু দূষণ বাড়ছে, যা আশপাশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সমাধানের উপায় কী?

এই সমস্যা সমাধানে কৃষকদের সচেতন করা, বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা, ইটভাটার কাঁচামাল ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা এবং সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। প্রথমত, কৃষকদের বোঝাতে হবে যে জমির উর্বর মাটি বিক্রি করলে তারা সাময়িক অর্থ পেলেও ভবিষ্যতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। দ্বিতীয়ত, সরকার যদি কৃষকদের জন্য সহজলভ্য কৃষি ঋণ, ভর্তুকি ও বিকল্প আয়ের সুযোগ তৈরি করে, তাহলে তারা জমির মাটি বিক্রি না করেও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে পারবেন।

তৃতীয়ত, অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশবান্ধব ব্লক ইটের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং আইন মেনে বৈধ ইটভাটাগুলোকেও কৃষিজমির মাটি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বদরগঞ্জের ইউএনও বলেন, “অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, কিন্তু কৃষকদের সচেতন না করলে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।”

শেষ কথা

কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর মাটি হারালে সেটি পুনরুদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আজ যদি এই সমস্যা নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশ ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়বে। কৃষক, প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

আপনার মতামত কী? আপনি কি মনে করেন, ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার? কমেন্টে জানিয়ে দিন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ