বাংলাদেশের সুন্দরবন, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, আজ এক বড় পরিবেশগত বিপদের সম্মুখীন। বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী রায়েন্দা খাল একসময় কৃষি, মৎস্য এবং বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ রুট ছিল, কিন্তু বর্তমানে প্লাস্টিক, পলিথিন এবং বিভিন্ন প্রকার বর্জ্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এই খালটি শুধু স্থানীয় জনগণের জীবিকা নয়, বরং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এটি যদি এর বর্তমান অবস্থা অব্যাহত রাখে, তবে পরিবেশ এবং জলবায়ু বিষয়েও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। রায়েন্দা খালে প্লাস্টিক বর্জ্য
খালের মৃত্যু: স্থানীয়দের অবহেলা ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের অভাব
শরণখোলা উপজেলায় রায়েন্দা খালটির দক্ষিণ পাড় এখন প্লাস্টিক, পলিথিন ও বর্জ্যের পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। বাজারের বর্জ্য, আবর্জনা এবং বাসাবাড়ির ময়লা খালের পাড়ে ফেলা হচ্ছে, যা খালটির পানি দূষিত করছে। খালের পাড়ে জমে থাকা এই বর্জ্য জোয়ার-ভাটায় পানিতে ভেসে গিয়ে সুন্দরবনের নদ-নদী ও খালে পৌঁছাচ্ছে, যা পরবর্তীতে মৎস্যজীবী, কৃষক এবং স্থানীয়দের জীবিকা বিপন্ন করতে পারে। একদিকে ময়লা ও বর্জ্য, অন্যদিকে প্রশাসনিক উদ্যোগের অভাব—এই দুটি সমস্যা খালটির মৃত প্রায় হওয়ার জন্য দায়ী।
পরিবেশ ও সুন্দরবনে বর্জ্যের প্রভাব
রায়েন্দা খালটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হিসেবে কাজ করত, যা বলেশ্বর নদীর সাথে সংযুক্ত হয়ে সুন্দরবনকে পৌঁছাত। কিন্তু খালটির পাড়ে জমে থাকা প্লাস্টিক এবং পলিথিন পরিবেশের জন্য হুমকি তৈরি করছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত ক্ষতি ত্বরান্বিত করার জন্য এই অপচনশীল বস্তুগুলো বিশেষভাবে দায়ী। বলেশ্বর নদী এবং খালের অন্যান্য শাখায় এটি গিয়ে আটকে যাচ্ছে এবং সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনের জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মৎস্য ও কৃষি খাতে ভয়াবহ প্রভাব
এ অঞ্চলের কৃষি জীবিকা খালটির পানি প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু খালটি মৃত হয়ে যাওয়ায় জলবায়ু এবং মাটি-ভরাটের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। জলস্তরের কমে যাওয়া এবং পানি প্রবাহের অভাবে কৃষকরা তাদের চাষাবাদের জন্য সঠিক সময়ে পানি পাচ্ছেন না। এমনকি, মাছ ধরার জন্য যে ট্রলারগুলো খাল দিয়ে যাতায়াত করত, তারা এখন চরে আটকা পড়ছে, যা মৎস্যজীবীদের জন্য বিপর্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায়, খালটি যদি খনন না করা হয় এবং বর্জ্য অপসারণ না হয়, তবে কৃষি এবং মৎস্য খাতে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হতে পারে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ
রায়েন্দা বাজারে প্রায় দুই সহস্রাধিক দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং বাসাবাড়ি রয়েছে, এবং ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল নৌপথে ঢাকাসহ অন্য শহর থেকে এনে বিক্রি করতেন। কিন্তু খালের পাড়ে ময়লা এবং বর্জ্য জমে যাওয়ায় নৌযান চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে। ভাটির সময় জাহাজ ও ট্রলারগুলো চরে আটকা পড়ছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। একে একে তারা দাবি করছেন খালটি খনন এবং ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট স্থান গড়ে তোলার।
সুন্দরবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
এ পরিস্থিতিতে, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। স্থানীয় কৃষক, মৎস্যজীবী এবং ব্যবসায়ীদের দাবি, খালটি খনন করে তার নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং ময়লা, পলিথিনসহ অন্যান্য বর্জ্য সরিয়ে ফেলতে হবে। না হলে, শুধুমাত্র রায়েন্দা খালই নয়, বরং পুরো সুন্দরবন এবং তার জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।
এই বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার আশ্বাস দিয়েছে, তবে এই উদ্যোগগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুদীপ্ত কুমার সিংহ জানিয়েছেন, খালটি রক্ষার জন্য শিগগিরই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
সুন্দরবন রক্ষায় আমাদের ভূমিকা
সুন্দরবন রক্ষায় শুধু প্রশাসন ও স্থানীয়দের উদ্যোগের প্রয়োজন নয়, আমাদেরও এই পরিবেশগত বিপর্যয় সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলার অভ্যাস বদলাতে হবে। প্লাস্টিক দূষণ শুধু আমাদের দেশে নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্য এক বড় সমস্যা। সুতরাং, সুন্দরবনের রক্ষা এবং পরিবেশের উন্নতি ত্বরান্বিত করতে, আমাদের সবাইকে এখন থেকেই সচেতন হতে হবে।
সমাপ্তি: পরিবেশ রক্ষার জন্য একযোগে কাজ করতে হবে
বাংলাদেশের সুন্দরবন এবং রায়েন্দা খাল আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের রক্ষক। কিন্তু এটি রক্ষার জন্য আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, খাল খনন, এবং প্রশাসনিক উদ্যোগ নিয়ে সুন্দরবনকে রক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া গেলে, আমরা ভবিষ্যতে একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ উপভোগ করতে পারব।
তাহলে, আসুন আমরা একযোগে কাজ করি পরিবেশ রক্ষায়। আমাদের সামান্য প্রয়াসও বড় পরিবর্তন আনতে পারে।