22 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৫
spot_img

বন কর্মকর্তা নাকি দুর্নীতির সম্রাট? মোল্যা রেজাউল করিমের দুর্নীতির বিস্ফোরক চিত্র

বাংলাদেশের বন অধিদফতর: দায়িত্ব নাকি দুর্নীতির ঘাঁটি?

বাংলাদেশের বন অধিদফতরের মূল কাজ পরিবেশ রক্ষা, বন সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্যের টেকসই ব্যবস্থাপনা। কিন্তু বাস্তবে কি সেটাই ঘটছে? নানা সময় এই দপ্তরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বর্তমান বন সংরক্ষক (সিএফ) মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে উঠে আসা অভিযোগগুলো তারই একটি চরম উদাহরণ। দুর্নীতির সম্রাট

এক সময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এই কর্মকর্তা কীভাবে পুরো বন বিভাগকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করলেন, কীভাবে তদন্তগুলো বারবার ধামাচাপা পড়ে গেল—এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমাদের আজকের অনুসন্ধান।

মোল্যা রেজাউল করিম: নামের সঙ্গে দুর্নীতির ছায়া

সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক আতঙ্কের নাম। অভিযোগ রয়েছে, মোল্যা রেজাউল করিম বন বিভাগকে পরিণত করেছিলেন দুর্নীতির এক বিশাল নেটওয়ার্কে। চাকরির শুরু থেকেই তিনি কৌশলে নিজেকে উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ক্ষমতার বলয় বাড়তে থাকে।

২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বন অধিদফতরের তৎকালীন প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. ইউনুছ আলী তার দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু সেই চিঠিগুলো ফাইলের স্তূপে চাপা পড়ে যায়। দুর্নীতির সম্রাট

২০১৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা হলেও আজ পর্যন্ত এর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।

উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অর্থ লোপাট

তিনি যখন ঢাকার মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পরিচালক ছিলেন (২০১৭-২০১৯), তখন সরকারি অডিট প্রতিবেদনে উঠে আসে ভয়ংকর সব তথ্য। অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি উন্নয়ন বাজেট দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

একটি গভীর নলকূপ স্থাপনে প্রকৃত খরচ হয় ৩০ লাখ টাকা, কিন্তু কাগজে দেখানো হয় সাড়ে ৭০ লাখ টাকা! এছাড়া পুকুর খননের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ, ভুয়া বিল ও ভাউচারের মাধ্যমে সরকারি অর্থ লোপাটের ঘটনাও তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে। দুর্নীতির সম্রাট

বন ধ্বংস করে অর্থ হাতানো

মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে বন ধ্বংস করে অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহ করা। চাকরিজীবনের শুরুতেই, যখন তিনি রাঙ্গামাটি দক্ষিণ বন বিভাগের কাপ্তাই রেঞ্জের কর্মকর্তা ছিলেন, তখনই অভিযোগ ওঠে যে তিনি সরকারি সেগুন বাগান গোপনে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

পরবর্তীতে ফেনী ডিভিশনের দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি বাগান সৃজন প্রকল্প ও ইকোপার্ক উন্নয়ন তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করেন। তদন্তে এসব প্রমাণিত হলেও, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অভিযোগের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যখন এত অভিযোগ, তখন সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কী বলছে?

দুদকের জনসংযোগ পরিচালক আকতার উল ইসলাম জানিয়েছেন, “কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা স্বাভাবিক নিয়মেই তদন্ত হয়। বন অধিদফতরের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও তদন্ত হবে।”

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—কবে? এত বছর ধরে অভিযোগ থাকার পরও কেন তা আলোর মুখ দেখেনি? প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, “কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এমন বক্তব্য আমরা আগেও অনেকবার শুনেছি, কিন্তু বাস্তবে কি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে? নাকি এই অভিযোগও আগের মতোই ধামাচাপা পড়ে যাবে?

বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ

এই দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বন বিভাগের ভেতরেও প্রতিবাদ হয়েছে।

২০১৯ সালে বন অধিদফতরের ২০ জন ফরেস্টার মোল্যা রেজাউলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। তারা বলেন, “আমরা শুধু তার দুর্নীতির শিকার নই, তার স্বৈরাচারী ব্যবস্থাপনার শিকারও। অধঃস্তন কর্মচারীদের ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে তিনি তার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করেছেন।”

এত বড় একটি দুর্নীতির জাল গড়ে উঠল, অথচ কীভাবে বছরের পর বছর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?

রাজনৈতিক রং বদলের খেলা: সুবিধাবাদিতার চরম উদাহরণ

বন অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, মোল্যা রেজাউল করিমের অন্যতম কৌশল ছিল ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।

এক সময় তিনি শেখ হাসিনার সরকারে প্রভাবশালী মহলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলের পর তিনি হঠাৎ করে বিএনপির অনুসারী হয়ে যান। বর্তমান সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখেই তিনি নিজেকে সংস্কারপন্থী সাজিয়ে নতুন ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশের চেষ্টা করছেন।

একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান বদলে বারবার সুবিধা আদায় করেন, মোল্যা রেজাউল করিম তার একটি বড় দৃষ্টান্ত।

উপসংহার: আমরা কি এভাবেই চলব?

এমন এক দেশ যেখানে বন সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা নিজেই বন উজাড় করে দেয়, সেখানে পরিবেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা কীভাবে আশাবাদী থাকি?

সরকারের উচিত দ্রুততার সঙ্গে এই দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। জনগণের অর্থ ও প্রাকৃতিক সম্পদের এমন লুটপাট কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

আপনার মতামত দিন!

আপনি কি মনে করেন, সরকারের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া? নাকি এসব ঘটনা আগের মতোই হারিয়ে যাবে? আপনার মতামত কমেন্টে জানান!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ