27 C
Bangladesh
বৃহস্পতিবার, জুন ২৬, ২০২৫
spot_img

পর্যটনের স্বর্গ সাজেক পুড়ে ছাই: ফায়ার সার্ভিস নাকি সরকার—দোষী কে?

সাজেকের ভয়াবহ বিপর্যয়

রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি, বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র, এখন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে শুরু হওয়া এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সাজেকের ১৪০টিরও বেশি রিসোর্ট, কটেজ, দোকান ও বসতঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন এতটাই তীব্র ছিল যে মুহূর্তের মধ্যে তা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, নিঃস্ব করে দেয় রিসোর্ট মালিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। ১৪০+ রিসোর্ট পুড়ে ছাই

এই অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি পর্যটন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও জরুরি সেবা ব্যবস্থার ব্যর্থতার নগ্ন প্রকাশ। সাজেকের অধিকাংশ রিসোর্ট কাঠ ও বাঁশের তৈরি, যা আগুনের দ্রুত বিস্তারের অন্যতম কারণ। পর্যটকেরা নিরাপদে এলাকা ছাড়তে পারলেও ব্যবসায়ীরা দেখেছেন, কীভাবে তাদের বহু বছরের বিনিয়োগ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ধ্বংস হয়ে গেল।

ফায়ার সার্ভিসের বিলম্ব ও সরকারের প্রস্তুতির অভাব

সাজেকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রে এখনো কোনো ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নেই। ফলে দীঘিনালা থেকে ফায়ার সার্ভিস পাঠানো হয়, যা দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে পৌঁছাতে সময় নেয় দুই ঘণ্টারও বেশি। এই সময়ের মধ্যে আগুন এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, সাজেকের পানি সংকটও আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরির অন্যতম কারণ। নিকটস্থ জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালানো হয়, যা অত্যন্ত অপ্রতুল ছিল। যখন আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন হেলিকপ্টারের মাধ্যমে পানি ছিটানোর পরিকল্পনা করা হলেও সেটি কার্যকর হয়নি। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় এই উদ্যোগ বাতিল করা হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

এই অগ্নিকাণ্ডের পেছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে সরকারের অব্যবস্থাপনা ও অপ্রস্তুত থাকা। পর্যটন খাতের বিকাশের কথা বলা হলেও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় ন্যূনতম অবকাঠামো এখনো গড়ে তোলা হয়নি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনিক কার্যক্রম চালালেও জরুরি সেবাসমূহের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সাজেকের মতো একটি দুর্গম এলাকায় পর্যটন শিল্পকে ঘিরে বিশাল বিনিয়োগ থাকলেও সেখানে ফায়ার সার্ভিস, চিকিৎসা কেন্দ্র বা জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থার মতো মৌলিক সুবিধা নেই। ১৪০+ রিসোর্ট পুড়ে ছাই

প্রশ্ন উঠছে, সাজেকের মতো জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে কেন এখনো জরুরি সেবার অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি? কেন প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে এই সংকটকে উপেক্ষা করেছে? ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাগার পরেও কেন বিকল্প কোনো ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়নি?

এই ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, পর্যটন খাতের উন্নয়নের নামে প্রচারণা চালানো হলেও বাস্তবসম্মত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি না থাকা, যথাসময়ে ফায়ার সার্ভিস না পৌঁছানো এবং হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে ব্যর্থতা—সবই সরকারের প্রস্তুতির অভাবকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর এর প্রভাব

সাজেক শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশের অন্যতম সংবেদনশীল পরিবেশগত এলাকা। এই অগ্নিকাণ্ড শুধু রিসোর্টগুলোর ক্ষতি করেনি, বরং আশপাশের বনভূমি ও প্রতিবেশগত ভারসাম্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।

বনভূমির একাংশ আগুনে পুড়ে যাওয়ায় সেখানে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে। পাহাড়ি এলাকায় আগুন লাগার ফলে মাটি উর্বরতা হারায়, যা দীর্ঘমেয়াদে এলাকার পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। বিশাল পরিমাণ ধোঁয়ার ফলে বায়ু দূষণ বেড়েছে, যা শুধু সাজেক নয়, আশপাশের এলাকাগুলোর পরিবেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও বড় সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে এখন আগুন লাগার ঘটনা আরও বেশি মারাত্মক হয়ে উঠছে। পাহাড়ি এলাকাগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আগেই অনুভূত হচ্ছিল, আর এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড সেই সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে।

সাজেক পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ

এই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পর এখন প্রশ্ন উঠছে, সাজেক কীভাবে পুনর্গঠিত হবে?

সরকার যদি দ্রুত আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত রিসোর্ট মালিকরা আবার ব্যবসা চালু করতে পারবেন না। অনেক মালিক ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, যা এখন তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

সাজেককে পুনরায় গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে, ভবিষ্যতে যেন এমন বিপর্যয় না ঘটে। পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি আগুনের ঝুঁকি কমানোর জন্য রিসোর্টগুলোর অবকাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। কাঠ ও বাঁশের পরিবর্তে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সংযুক্ত আধুনিক স্থাপত্য পরিকল্পনা নিতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সাজেকের মতো দুর্গম পর্যটন এলাকায় স্থায়ী ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা জরুরি। প্রশাসনের উচিত দ্রুত এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা

সাজেকের এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের জরুরি সেবার ব্যর্থতা, পর্যটন খাতের দুর্বলতা এবং পরিবেশগত ঝুঁকির নগ্ন প্রকাশ। সরকারের উচিত এখনই এ থেকে শিক্ষা নিয়ে সাজেকসহ দেশের অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্মূল্যায়ন করা। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকেই যাবে।

এখন প্রশ্ন হলো, সাজেকের পুনর্গঠন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী করা উচিত? স্থানীয় পর্যটন ব্যবস্থাপনা কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়? আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

আরও পড়ুন

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ