বাংলাদেশে হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। অপরিশোধিত বর্জ্য পানি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে, যা রোগজীবাণুর বিস্তার ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাড়িয়ে তুলছে। তবে আশার খবর হলো, ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল দেশের প্রথম কম খরচে টেকসই হাসপাতাল বর্জ্য পানি পরিশোধন প্লান্ট (WWTP) স্থাপন করেছে, যা হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে নতুন দিগন্ত
হাসপাতাল বর্জ্য পানি: পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
হাসপাতালগুলোর বর্জ্য পানি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া, ভারী ধাতু ও অন্যান্য বিপজ্জনক রাসায়নিক উপাদান বহন করে। বর্তমানে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-২০২৩ অনুযায়ী, ৫০ শয্যার বেশি হাসপাতালগুলোকে ‘রেড ক্যাটাগরি’ প্রকল্প হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, যার অর্থ তারা পরিবেশের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। এই বিধিমালায় হাসপাতালগুলোর জন্য ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ETP) স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে বাস্তবতা হলো, ঢাকার অধিকাংশ হাসপাতাল এখনও কার্যকর বর্জ্য পানি পরিশোধন ব্যবস্থা চালু করেনি। বেশিরভাগ হাসপাতাল সেপটিক ট্যাংক বা অ্যানঅ্যারোবিক ব্যাফল রিঅ্যাক্টরের মতো পুরোনো প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করছে, যা অপর্যাপ্ত এবং সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে অপরিশোধিত বর্জ্যপানি সরাসরি ড্রেনেজ ব্যবস্থায় মিশে গিয়ে নদী ও ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করছে, যা রোগ সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের WWTP: কীভাবে কাজ করে?
কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের নতুন স্থাপিত পরিশোধনাগারটি ২৪ কিলোলিটার পার ডে (KLD) ক্ষমতাসম্পন্ন এবং মেমব্রেন বায়োরিঅ্যাক্টর (MBR) প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত।
এই ছয়-ধাপ বিশিষ্ট আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে:
✔ হাসপাতালের বর্জ্য পানি থেকে ১০০% রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু (E. Coli, Vibrio Cholera, Salmonella Typhi) অপসারণ করা হয়।
✔ ৯৯% রোটাভাইরাস এ হ্রাস নিশ্চিত করা হয়েছে।
✔ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধ করা হয়।
✔ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-২০২৩-এর নির্ধারিত মানদণ্ড সম্পূর্ণরূপে পূরণ করে।
✔ পরিশোধিত পানি পুনঃব্যবহারযোগ্য, যা বাগান পরিচর্যা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও অন্যান্য অপানীয় কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
✅ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা: অপরিশোধিত হাসপাতাল বর্জ্য পানি সরাসরি নদী বা ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে দূষণ ছড়ায়। নতুন WWTP প্রযুক্তি এটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করবে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে নতুন দিগন্ত
✅ রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ: হাসপাতালের বর্জ্য পানি সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম। এই প্রযুক্তি ১০০% জীবাণুমুক্ত পানি তৈরি করায় রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক কমবে।
✅ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হ্রাস: অপরিশোধিত বর্জ্যপানিতে থাকা ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া মানুষের শরীরে প্রবেশ করে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বাড়ায়, যা একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট। WWTP এটি নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক হবে।
✅ স্বল্প খরচে টেকসই সমাধান: আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও এটি অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স খরচ তুলনামূলকভাবে কম, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্টের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. জয়নাল আবেদিন টিটো এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন,
“এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক উদ্ভাবন। এটি যদি দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও চালু করা যায়, তাহলে আমাদের হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে।”
আইসিডিডিআর,বি-র এনভায়রনমেন্ট হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ ইউনিটের সহযোগী বিজ্ঞানী ডা. মো. নুহু আমিন বলেন,
“এই প্রযুক্তি এখন আর পরীক্ষামূলক মডেল নয়, এটি একটি কার্যকর ও স্বল্প খরচের সমাধান যা হাসপাতালের বর্জ্য পানি থেকে পুনঃব্যবহারযোগ্য পানি উৎপাদনে সক্ষম।”
বুয়েটের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ বলেন,
“এই সহজ প্রযুক্তি বাংলাদেশসহ বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য একটি টেকসই সমাধান হতে পারে।”
এটি কি বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্টের নেতৃত্বে পরিচালিত এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আইসিডিডিআর,বি, ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনি (UTS) এবং বুয়েটের আইটিএন সেন্টার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি এই মডেলটি অন্যান্য হাসপাতালেও সম্প্রসারণ করা হয়, তাহলে হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি বড় পরিবর্তন আসবে। এটি শুধু পরিবেশের জন্য উপকারী হবে না, বরং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
শেষ কথা
কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে স্থাপিত এই নতুন প্রযুক্তির বর্জ্য পরিশোধনাগার আমাদের দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন। এটি শুধুমাত্র পরিবেশ সুরক্ষা নয়, বরং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখবে।
এই প্রযুক্তি যদি দেশের প্রতিটি হাসপাতালে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আমরা হাসপাতাল বর্জ্যের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারব।
আপনার মতামত কী? আপনি কি মনে করেন, দেশের প্রতিটি হাসপাতালে এমন পরিশোধনাগার থাকা উচিত? আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন! ⬇️