কেন গঙ্গা চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন সংক্রান্ত গঙ্গা চুক্তি ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল গঙ্গার পানির ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা, যাতে বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় পক্ষ উপকৃত হতে পারে। ২০২৬ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা, তাই দুই দেশ এখন এটি পর্যালোচনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবারের ৮৬তম যৌথ নদী কমিশনের (JRC) বৈঠক হবে কলকাতা ও ফারাক্কায়, যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞরা অংশ নেবেন। গঙ্গা চুক্তি নবায়ন ও পর্যালোচনা
এই আলোচনা শুধু রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক বিষয় নয়, বরং এর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে পরিবেশ ও জলবায়ুর বিষয়। গঙ্গার পানিবণ্টন সঠিকভাবে না হলে এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের নদী নির্ভর কৃষি, জীববৈচিত্র্য এবং জলবায়ুর ওপর।
গঙ্গা চুক্তি: ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি
১৯৯৬ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী, ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে গঙ্গার পানি নির্দিষ্ট হারে দুই দেশে বণ্টন করা হবে, যা ৩০ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। তবে, বাস্তবে পানি প্রবাহের তারতম্যের কারণে বাংলাদেশ অনেক সময় পর্যাপ্ত পানি পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এবারের বৈঠকে চুক্তি নবায়নের পাশাপাশি নতুন কিছু বিষয় আলোচনায় আসতে পারে:
- গঙ্গার পানিপ্রবাহের বর্তমান অবস্থা
- পরিবেশগত প্রভাব ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি প্রবাহে পরিবর্তন
- ভবিষ্যৎ চুক্তিতে তিস্তা ও অন্যান্য অভিন্ন নদীর অন্তর্ভুক্তি
পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর গঙ্গা চুক্তির প্রভাব
গঙ্গার পানিবণ্টন শুধু দুই দেশের রাজনৈতিক বিষয় নয়, বরং এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত পরিবেশ ও জলবায়ু। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি না পায়, তাহলে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে –
১. কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব
গঙ্গার পানি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত পানি না পেলে কৃষকদের সেচ সুবিধা কমে যাবে, যা ফসলের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে বোরো ধান, পাট ও অন্যান্য মৌসুমি ফসলের ফলন কমে যেতে পারে। গঙ্গা চুক্তি নবায়ন ও পর্যালোচনা
এছাড়া, গঙ্গার পানির সঠিক প্রবাহ নিশ্চিত না হলে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কারণ এই অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যেতে পারে। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের জন্য একটি বড় পরিবেশগত হুমকি।
২. জলবায়ু পরিবর্তন ও পানির প্রবাহে পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারত ও বাংলাদেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হলেও, শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট প্রকট হয়। গঙ্গার প্রবাহে কোনো পরিবর্তন বা বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে মরুকরণের আশঙ্কা বাড়ছে।
৩. নদীভাঙন ও পানির সংকট
যদি ফারাক্কা থেকে পর্যাপ্ত পানি বাংলাদেশে প্রবাহিত না হয়, তাহলে নদীগুলোর স্বাভাবিক গতি কমে যাবে। এর ফলে বাড়বে নদীভাঙন ও খরার প্রকোপ। বিশেষ করে পদ্মা নদীর প্রবাহ কমে গেলে বাংলাদেশে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিতে পারে।
গঙ্গা চুক্তি পর্যালোচনা: ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি
গঙ্গা চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এই চুক্তির ফলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক ও জনগণ পানির সংকটে পড়তে পারে। ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে লেখা এক চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পরামর্শ না করেই চুক্তি করা হয়েছে, যা একতরফা সিদ্ধান্ত।
তবে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের প্রতিনিধিদের নিয়ে ২০২৩ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করবে।
বাংলাদেশের জন্য এই বৈঠক তাই শুধু ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গের মতামতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ তিস্তা চুক্তির মতো অনেক আলোচনা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতার কারণে আটকে আছে।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সফরসূচি ও বৈঠকের মূল এজেন্ডা
৮৬তম যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের জন্য বাংলাদেশ থেকে মোহাম্মদ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল ভারতে যাচ্ছে। তাঁদের সফরসূচি:
- ৩ মার্চ: কলকাতায় পৌঁছানো ও ফারাক্কার উদ্দেশ্যে রওনা
- ৪ মার্চ: ফারাক্কায় গঙ্গার পানিপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ
- ৫ মার্চ: কলকাতা ফেরা
- ৬ মার্চ: হায়াত রিজেন্সি হোটেলে মূল বৈঠক
- ৭ মার্চ: প্রযুক্তিবিদ পর্যায়ের আলোচনা
- ৮ মার্চ: বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন
প্রতিনিধিদল এই বৈঠকে চুক্তির নবায়ন, পানির প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, জলবায়ুর প্রভাব, কৃষি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার উপায় নিয়ে আলোচনা করবে।
চূড়ান্ত কথা: গঙ্গা চুক্তি কি বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে?
আগামী বছর গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নতুন চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা রক্ষা হবে, তা নির্ভর করছে এই বৈঠকগুলোর ফলাফলের ওপর। তবে শুধু রাজনৈতিক আলোচনা নয়, বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর ভিত্তি করে চুক্তির নবায়ন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য গঙ্গার পানি শুধু একটি কূটনৈতিক বিষয় নয়, বরং জীবন ও জীবিকার অংশ। তাই, এই চুক্তির পর্যালোচনা নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।