দিনাজপুরের আত্রাই নদী একসময় ছিল উচ্ছ্বাসমুখর, খরস্রোতা এক জলধারা। বর্ষার সময় নদীর গর্জন আশপাশের গ্রামগুলোতে শিহরণ জাগাত, আর শুষ্ক মৌসুমেও এর প্রবাহ টিকে থাকত। কিন্তু আজ সেই আত্রাই ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকের বেশিরভাগ জায়গায় এখন শুধুই বালি আর ধুলো, আর যে সামান্য পানি আছে, তা যেন কষ্টেসৃষ্টে কোনোভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার পশ্চিম সীমানাজুড়ে প্রবাহিত এই ঐতিহ্যবাহী নদীকে ঘিরে একসময় গড়ে উঠেছিল জনপদ, গড়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। নদীর আশপাশের শত শত জেলে পরিবার নদীর মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এখন নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় মাছের অস্তিত্বও কমে গেছে। বাধ্য হয়ে অনেক জেলে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন।
কীভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে আত্রাই?
একসময় প্রাণবন্ত নদীটি কীভাবে এমন মরা খালে পরিণত হলো? এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে—
১. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে। বর্ষার সময় হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেও শুষ্ক মৌসুমে দীর্ঘ সময় ধরে খরা দেখা দেয়। এর ফলে নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না।
২. নাব্যতা হারানো
নদীটি দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত ড্রেজিং বা খনন না করার ফলে নাব্যতা হারিয়েছে। নদীর তলদেশ ক্রমশ পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে, ফলে পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। একসময় যেখানে গভীর নদী ছিল, এখন সেখানে হাঁটুসমান পানি আর বালুচর।
৩. অপরিকল্পিত বাঁধ ও পানি ব্যবস্থাপনা
নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের পথে বাধা সৃষ্টি করে এমন বাঁধ বা জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। এর ফলে বর্ষাকালে হঠাৎ বন্যা দেখা দিলেও শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। পানি প্রবাহের এই অসমতার ফলে নদীর স্বাভাবিক গঠন ধ্বংস হয়ে গেছে।
৪. অবৈধ দখল ও কৃষিকাজ
নদীর বুকে চর জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনেকে সেই জায়গায় কৃষিকাজ শুরু করেছেন। কেউ কেউ চারা বপন করছেন, কেউ আবার স্থায়ী বসতি গড়ে তুলছেন। এতে নদীর স্বাভাবিক বিস্তৃতি কমে যাচ্ছে এবং এর প্রবাহ দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
একটি নদী শুকিয়ে যাওয়ার অর্থ কী?
নদী শুধু জলধারা নয়, এটি একটি বিস্তৃত বাস্তুতন্ত্র। একটি নদীর মৃত্যু মানে আশপাশের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস। আত্রাই শুকিয়ে যাওয়ার ফলে কী কী সমস্যা তৈরি হতে পারে?
- জীবিকা হারানো: জেলেদের জীবিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ফলে তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
- কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব: নদীর পানি কমে গেলে আশপাশের কৃষি জমিগুলোর জন্য সেচের পানি পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে, ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যেতে পারে।
- ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া: নদীর পানির প্রবাহ কমলে আশপাশের এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাবে, যা ভবিষ্যতে বিশুদ্ধ পানির সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
- জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস: নদীতে যেসব মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বাস করত, তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে।
- স্থানীয় জলবায়ুর পরিবর্তন: নদী শুকিয়ে গেলে আশপাশের এলাকায় আর্দ্রতার পরিমাণ কমে যাবে, যা আরও খরার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
এখন কী করা উচিত?
এই সমস্যা সমাধানের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। আত্রাই নদীকে বাঁচানোর জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে—
১. পরিকল্পিতভাবে নদীর পুনরুদ্ধার
- নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নিয়মিত ড্রেজিং বা খনন কাজ চালানো দরকার।
- নদীর বুকে গড়ে ওঠা অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে।
- বাঁধ ও জলাধার নির্মাণের ক্ষেত্রে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখা জরুরি।
২. জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ
- বনভূমি সংরক্ষণ ও পুনঃবনায়ন করা হলে বৃষ্টিপাতের হার স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করতে পারে।
- খরা প্রতিরোধে পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা উন্নত করা প্রয়োজন।
৩. স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা
- নদী রক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
- নদীকে বাঁচাতে কী করা যেতে পারে, সে বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে।
৪. জেলেদের পুনর্বাসন ও বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা
- নদীতে মাছের উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
- যেসব জেলে নদী থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
শেষ কথা
আত্রাই নদী একসময় প্রাণবন্ত ছিল, এখন সেটি ধুঁকছে। এটি শুধুই একটি নদীর গল্প নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও অবহেলার প্রতিচিত্র।
এখনই ব্যবস্থা না নিলে হয়তো একসময় আত্রাই নদী কেবল মানচিত্রে নাম হিসেবে থাকবে, বাস্তবে নয়। নদী রক্ষায় আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আপনি কী মনে করেন? নদী রক্ষায় আরও কী কী করা যেতে পারে? আপনার মতামত জানাতে পারেন।