বাংলাদেশ এবং তার আশপাশে ভূমিকম্পের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, এই বৃদ্ধি বড় ভূমিকম্পের পূর্বসন্ধান হতে পারে, যা দেশের ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। ভূমিকম্পের পরিসংখ্যান এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, বাংলাদেশে এবং তার আশপাশে ভূমিকম্পের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। এই পোস্টে, আমরা বিশ্লেষণ করব কেন ভূমিকম্পের এই বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এবং কীভাবে আমরা প্রস্তুতি নিতে পারি। বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়ছে
ভূমিকম্পের গতি বৃদ্ধি: বাংলাদেশ এবং আশপাশের এলাকা
২০২৪ সালে বাংলাদেশ এবং আশপাশে প্রায় ৫৩টি ভূমিকম্প হয়েছে, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে অধিকাংশ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নেপাল, ভারতের আসাম, এবং পশ্চিমবঙ্গের আশপাশের এলাকায়। এই ভূমিকম্পগুলো সাধারণত মাঝারি মাত্রার (৫ থেকে ৫.৫ রিখটার স্কেল) হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এর শক্তি আরও বেশি ছিল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ইউনিটের বৃদ্ধি, তবে ভূমিকম্পের প্রকৃত সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। ২০১৭ সালে ২৮টি ভূমিকম্প হয়েছিল, যা ২০২৩ সালে বেড়ে ৪১টি হয়, এবং ২০২৪ সালে তা ৫৩টি ছাড়িয়ে গেছে।
ভূমিকম্পের কারণ এবং তাৎপর্য
ভূমিকম্পের মূল কারণ হল পৃথিবীর ভেতরের টেকটোনিক প্লেটগুলোর গতিবিধি। যখন দুটি প্লেট একে অপরের সাথে সংঘর্ষে আসে, তখন শক্তির সৃষ্টি হয় এবং সেই শক্তি সিসমিক তরঙ্গের মাধ্যমে পৃথিবীর পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে, যা ভূমিকম্প হিসেবে অনুভূত হয়।
বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ একটি অঞ্চলে অবস্থিত, বিশেষ করে সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এবং হিমালয়ের পাদদেশবর্তী এলাকায়। এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের ঘটনা সাধারণত বেশি ঘটে। বিশেষত, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ সীমান্তের ভারত ও মিয়ানমারের সংলগ্ন অঞ্চলগুলি ভূমিকম্পের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা: বাংলাদেশে কী ঘটতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়ছে। ভূমিকম্পের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প সাধারণত ৭ বা তার চেয়ে বেশি রিখটার স্কেলে ফিরে আসে প্রতি ১২৫ থেকে ১৫০ বছর পর। সুতরাং, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় একটি বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়ছে
এর মধ্যে ১৭৬২ সালের গ্রেট আরাকান ভূমিকম্প অন্যতম, যার মাত্রা ছিল ৮.৫ রিখটার স্কেল। এর ফলে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা এমনকি ভারতের আসাম পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষতি হয়। একইভাবে, ১৮৯৭ সালের আসাম ভূমিকম্পের মাত্রাও ছিল ৮.৭ রিখটার স্কেল।
এমন ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি হলে দেশের শহরগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, যেখানে অপরিকল্পিত নির্মাণ, নকশা ও ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা প্রায় অপ্রতুল।
ঢাকা শহরে ভূমিকম্পের প্রভাব এবং প্রস্তুতির অভাব
ঢাকা, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর, যেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ বসবাস করে, ভূমিকম্পের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
এক্ষেত্রে, ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখনও যথেষ্ট উন্নত নয়। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আমাদের ভূমিকম্প মোকাবিলা প্রস্তুতি মূলত ক্ষয়ক্ষতি পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। নাগরিক শিক্ষা এবং মহড়া এখনো পর্যাপ্ত নয়। সঠিক তথ্য এবং সচেতনতা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়লে, ভূমিকম্পের ক্ষতিকর প্রভাব কমানো কঠিন হবে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূমিকম্পের সম্পর্ক
একটি প্রশ্ন যা এখানে উঠে আসে তা হলো, কি জলবায়ু পরিবর্তন ভূমিকম্পের ঘটনাকে ত্বরান্বিত করছে? যদিও ভূমিকম্প মূলত টেকটোনিক প্লেটের গতির কারণে ঘটে, তবুও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভূমিকম্পের তীব্রতা এবং এর গতি বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। মাটি এবং ভূস্তরের তাপমাত্রা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৃষ্টিপাতের মাত্রা ভূমিকম্পের ঘটনার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এই বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত প্রস্তুতি: কীভাবে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের প্রস্তুতি উন্নত করা যায়?
১. সচেতনতা বৃদ্ধি: নাগরিকদের ভূমিকম্পের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের প্রাথমিক প্রতিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করা।
২. ভূমিকম্প প্রতিরোধী নির্মাণ: নতুন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশা প্রয়োগ করা এবং পুরানো ভবনগুলোর সংস্কার করা।
৩. মহড়া ও প্রস্তুতি: স্থানীয় জনগণের জন্য নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া এবং প্রাথমিক উদ্ধার প্রস্তুতি আয়োজন করা।
৪. সরকারি উদ্যোগ: সরকারী উদ্যোগে দ্রুত এবং কার্যকরী ভূমিকম্প সাড়া ব্যবস্থা তৈরি করা এবং ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকার সুরক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
শেষ কথা
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং এটি একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া অসম্ভব, তবে সঠিক প্রস্তুতি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করলে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমানো সম্ভব হতে পারে।
আপনার ভাবনা শেয়ার করতে বা ভূমিকম্প মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন, মন্তব্যে জানান।