ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি বর্তমানে এক মারাত্মক স্তরে পৌঁছেছে, যা শুধু পরিবেশের জন্য নয়, বরং মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া বায়ুদূষণ পরিস্থিতি জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে, যা রাজধানীর লাখ লাখ বাসিন্দার জন্য ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বায়ুর মানের এই অবনতি সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য একটি গুরুতর সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দূষণের ফলে শুধু যে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা নয়; এর ফলে শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, হৃদরোগ, এবং এমনকি যক্ষ্মার মতো রোগের সংক্রমণও দ্রুত বাড়ছে। ঢাকায় টানা বায়ুদূষণ রেকর্ড
বায়ুদূষণের অবস্থা: এক নজরে
গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার বায়ুমান ছিল একেবারে সর্বোচ্চ। একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে বায়ুর মান ২৬২ পৌঁছায়, যা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ‘দুর্যোগপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর আগে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বায়ুর মান ছিল ২৫৮, যা গত আট বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল। এর অর্থ হলো, ঢাকার বায়ু এতটাই দূষিত হয়ে উঠেছে যে এটি মানুষের স্বাস্থ্যকে সরাসরি বিপন্ন করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুদূষণের এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তবে শুধু শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা নয়, অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যাও জন্ম নেবে।
ঢাকার বায়ুদূষণ সিজনাল হলেও, গত বছরের নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস টানা দূষণের রেকর্ড দেখা গেছে। এ সময়কালটা বিশেষভাবে শুষ্ক মৌসুমের সময়, যেখানে ধূলিকণা ও অন্যান্য দূষণকারক উপাদান বাতাসে বেশি ভেসে থাকে। এই সময়ের মধ্যে, প্রায় প্রতিদিনই দূষণের মাত্রা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে, যা শহরবাসীর জন্য এক সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ঢাকায় টানা বায়ুদূষণ রেকর্ড
বায়ুদূষণের প্রধান কারণ
ঢাকার বায়ুদূষণের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- যানবাহন: ঢাকার যানবাহনগুলির ধোঁয়া একটি প্রধান দূষণকারী উপাদান। রাজধানীর রাস্তাগুলিতে প্রচুর গাড়ি চলাচল করে, যা বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত দূষণ ছাড়ে। তবে, সঠিকভাবে যানবাহনের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না, ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।
- কলকারখানা: ঢাকার আশেপাশে অবস্থিত কলকারখানাগুলির বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস। এসব কারখানার নির্গমন গ্যাস সরাসরি বাতাসে মিশে দূষণের পরিমাণ বাড়াচ্ছে।
- নির্মাণ কাজ: শহরে চলমান নির্মাণ কাজ থেকে উড়ে আসা ধূলিকণা দূষণের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। নির্মাণ প্রকল্পগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের অভাব আরও সমস্যা তৈরি করছে।
- ইটভাটা: ইটভাটাগুলির ধোঁয়া ও তাপ বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়াচ্ছে, বিশেষ করে ঢাকার আশপাশে ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে।
- প্রাকৃতিক কারণ: শুষ্ক মৌসুমে বাতাসে ধুলাবালু এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান বেড়ে যায়, যা বায়ু মানকে আরও খারাপ করে তোলে।
স্বাস্থ্যগত প্রভাব: শ্বাসকষ্টের মহামারি
ঢাকার বায়ুদূষণের ফলস্বরূপ, শ্বাসকষ্টের রোগী বাড়ছে দ্রুত। ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারিতে রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট, সর্দি, কাশি এবং ফুসফুসের অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক, জানিয়েছেন, “এ মাসে রোগীদের সংখ্যা বেড়েছে, যা দূষণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।” তিনি আরও বলেন, দূষণজনিত রোগগুলোর মধ্যে শ্বাসকষ্ট এবং যক্ষ্মা সবচেয়ে উদ্বেগজনক। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা প্রতিদিন ৩০০-৪০০ রোগী পাচ্ছেন, যারা দূষণজনিত কারণে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছেন।
বায়ুদূষণের প্রভাব ও সরকারের উদ্যোগ
বায়ুদূষণ রোধে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে, তবে সেগুলি পর্যাপ্ত নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গত জানুয়ারিতে এয়ার পিউরিফায়ারের ওপর শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যার ফলে এর বিক্রি বেড়েছে। তবে, এয়ার পিউরিফায়ারের দাম অনেক বেশি, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। এর পাশাপাশি, ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ পানি ছিটানোর মতো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু এর যথেষ্ট প্রভাব পড়ছে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান বলেছেন, “পানি ছিটানো হচ্ছে নিয়মিত, তবে গরমের কারণে ধুলাময় হয়ে যায়।” অন্যদিকে, ঢাকা উত্তরের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানিয়েছেন, “আমরা তিনবার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নিয়েছি, তবে ইটভাটা এবং গাজীপুরের কলকারখানার ধোঁয়া বড় সমস্যা।”
এছাড়া, দূষণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আব্দুস সালাম মন্তব্য করেছেন, “দূষণ নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বায়ুদূষণ দূর করতে সময়ভিত্তিক এবং এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়।”
বায়ুদূষণ মোকাবিলায় প্রস্তাবিত পদক্ষেপ
ঢাকার বায়ুদূষণ কমানোর জন্য কয়েকটি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
- যানবাহনের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ: রাজধানীজুড়ে যানবাহনের নির্গমন পরীক্ষার কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যেন কোন গাড়ি অতিরিক্ত দূষণ না ছাড়ে।
- নির্মাণ কাজ নিয়ন্ত্রণ: নির্মাণ কাজে ধুলাবালু নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। এতে দূষণের পরিমাণ কমবে।
- ইটভাটার দূষণ নিয়ন্ত্রণ: ইটভাটাগুলির জন্য পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যাতে তারা দূষণ ছড়াতে না পারে।
- পরিবেশবান্ধব কলকারখানা: কলকারখানাগুলির বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য কড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে হবে।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: নাগরিকদের দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, এবং তাদের পরিবেশবান্ধব অভ্যাস গঠনে উৎসাহিত করতে হবে।
শেষ কথা: ঢাকার ভবিষ্যত
ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে সরকারের, সিটি করপোরেশনের, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধুমাত্র পানি ছিটানো বা সীমিত পদক্ষেপ দূষণের বিস্তার রোধে কার্যকরী হবে না। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে ঢাকাকে একটি স্বাস্থ্যকর এবং বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
আপনার মতে, ঢাকার বায়ুদূষণ কমানোর জন্য কী পদক্ষেপ প্রয়োজন? মন্তব্যে আপনার মতামত জানান!
#ঢাকার_বায়ুদূষণ #পরিবেশ #জলবায়ু #শ্বাসকষ্ট #দূষণ_নিয়ন্ত্রণ #বায়ুদূষণ_রোধ #ঢাকা