বরিশাল শহরের মশার দাপট দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে এই বসন্তে মশার অস্বাভাবিক বিস্তার বাসিন্দাদের জন্য এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরিশাল সিটি করপোরেশন মশার উপদ্রব কমাতে নতুন করে ‘অলআউট কর্মসূচি’ গ্রহণ করেছে, যার মাধ্যমে ৭ দিনের মধ্যে নগরের সব ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু হবে। তবে, এই মশার উপদ্রবের পেছনে শুধুমাত্র পরিচ্ছন্নতা নয়, বরং পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও রয়েছে। অলআউট কর্মসূচি
মশার বিস্তার এবং জলবায়ু পরিবর্তন
মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন নানা উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করলেও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত অবক্ষয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশের অবস্থা খারাপ হওয়ায় বরিশাল নগরে মশার উপদ্রব আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
বরিশালের জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষত দুই কারণে প্রভাবিত হচ্ছে—একটি হলো অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি এবং অন্যটি হলো দীর্ঘ সময় ধরে জলাবদ্ধতা। বরিশাল শহরের ২২টি খাল একসময় জল প্রবাহিত করত, কিন্তু বর্তমানে সেগুলি বেশিরভাগই শুকিয়ে নালায় পরিণত হয়েছে। এর ফলে, বরিশাল নগরের বেশিরভাগ এলাকাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা মশার প্রজননের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে। বর্ষা মৌসুমে যেমন খালগুলো পানি ধারণ করত, এখন সেগুলি শুকিয়ে জলাশয়ে পরিণত হয়েছে, যেখানে মশার লার্ভা জন্মায়। এ পরিস্থিতি বরিশালের নগর পরিবেশের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভারী বৃষ্টি এবং তাপমাত্রার অনিয়মিত পরিবর্তন মশার উৎপত্তি ও বিস্তারে সহায়ক। গ্রীষ্মকাল ও বর্ষাকালে তাপমাত্রার বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতের অসমতাও মশার প্রজনন বাড়ানোর জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করছে। ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার কার্যক্রম বেশিরভাগ সময়ই গরম এবং আর্দ্র পরিবেশে বৃদ্ধি পায়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
‘অলআউট কর্মসূচি’ ও পরিবেশগত প্রভাব
বরিশাল সিটি করপোরেশন ‘অলআউট কর্মসূচি’ গ্রহণ করেছে যাতে নগরের বিভিন্ন স্থানে মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এতে ফগার মেশিন দিয়ে মশার বড়দের ধ্বংস করা হচ্ছে এবং লার্ভিসাইড প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে, শুধুমাত্র রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে মশা নিধন দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতে পারে না। মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনকে আরও পরিবেশবান্ধব এবং স্থায়ীত্বপূর্ণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
এছাড়া, মশা নিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি, পরিবেশের অবস্থা নিয়ে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, খাল পুনরুদ্ধার, এবং পরিচ্ছন্নতা বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশ সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিস মশা এবং অন্যান্য মশার প্রজননের জন্য পরিবেশগত অবস্থা আরও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, শহরের রাস্তা ও নির্মাণকাজের উপকরণ সঠিকভাবে পরিচালনা না করলে, সেগুলি মশার প্রজননস্থলে পরিণত হতে পারে। বরিশাল সিটি করপোরেশনকে সিটি পরিকল্পনার মধ্যে পরিবেশগত উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ডেঙ্গু, মশার বিস্তার এবং স্বাস্থ্য
বরিশালে মশার প্রজননের প্রধান কারণ হলো জলাবদ্ধতা এবং পরিবেশের অবস্থা, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তার ঘটাচ্ছে। গত বছর বরিশাল শহরসহ বিভাগের ৮,৪৫৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, এবং মারা গেছেন ৫৮ জন। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৯০ জন ছুঁয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, এখন বর্ষা মৌসুমের বাইরেও সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এটি একটি বড় উদ্বেগজনক বিষয়।
পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ও সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপ
বরিশাল নগরের পরিবেশের অবস্থা পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে। এক সময় ২২টি খাল বরিশাল শহর দিয়ে প্রবাহিত হতো, কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ খাল নর্দমায় পরিণত হয়েছে। খালগুলোর পানি প্রবাহিত না হওয়া এবং জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মশার উৎপত্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণ কাজের কারণে রাস্তা ও সড়কের উপর স্তূপ করা ইট-পাথর, বালু, এবং নির্মাণ সামগ্রীও মশার উৎপত্তিস্থলে পরিণত হচ্ছে।
এভাবে পরিবেশের অবক্ষয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন একত্রে মশার বিস্তার এবং ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়িয়ে তুলছে। সিটি করপোরেশন, সরকার এবং স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন, যাতে মশার বিস্তার কমানো সম্ভব হয় এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রতিরোধ করা যায়।
পরিবেশ বান্ধব পন্থা গ্রহণের গুরুত্ব
পরিবেশের উন্নয়নের জন্য সিটি করপোরেশনকে মশক নিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি কিছু পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন:
- জলাশয় পুনরুদ্ধার: বরিশালের খালগুলো পুনরুদ্ধার করা এবং সেগুলোর পানি প্রবাহিত করতে ব্যবস্থা নেওয়া।
- জলাবদ্ধতা দূরীকরণ: রাস্তা এবং খালগুলোতে জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য নালাগুলো পরিষ্কার এবং পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
- বহুতল ভবন নির্মাণ ও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবস্থা: নির্মাণ কাজের উপকরণ সঠিকভাবে ব্যবহার করা এবং সড়কের উপর স্তূপ না রাখার ব্যবস্থা নেওয়া।
কীভাবে মশা নিধন কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদী হবে?
- নির্মাণের সময় জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত রাখা: নির্মাণ কাজের ফলে মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ তৈরি না হতে পারে তা নিশ্চিত করা।
- পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ: রাসায়নিকের পরিবর্তে জৈব পদার্থ ব্যবহার করে মশা নিধন প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব উপায় অবলম্বন করা।
- সামাজিক সচেতনতা: স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন করা যাতে তারা তাদের আশপাশ পরিষ্কার রাখে এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয়।
শেষ কথা: সুষ্ঠু ও টেকসই উদ্যোগ দরকার
বরিশালে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম ইতিবাচক হলেও, এটি একমাত্র উপায় নয়। পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মশার বিস্তার আরও বাড়ছে। শুধুমাত্র পরিচ্ছন্নতা এবং মশক নিধন নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিও অত্যন্ত জরুরি। একে টেকসই ও কার্যকর সমাধানে পরিণত করতে হবে।
Call-to-Action আপনি কীভাবে মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারেন? আপনার মতামত শেয়ার করুন এবং বরিশালের পরিবেশ উন্নয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করুন!