সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, যা হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অবস্থিত, বাংলাদেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে এই উদ্যানে খাদ্য ও পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে, যার ফলে বানরসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী লোকালয়ে চলে আসছে। বনভূমির স্বাভাবিক খাদ্য উৎস কমে যাওয়ার কারণে বানররা মানুষের কাছ থেকে খাবার সংগ্রহের চেষ্টা করছে।
স্থানীয় পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বানরগুলো খাবারের দোকান, বাসস্থান এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোর আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পর্যটক বা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে খাবার চাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। এছাড়া, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক পার হতে গিয়ে অনেক বানর দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, ফলে কিছু বানর মারা যাচ্ছে এবং কিছু গুরুতর আহত হচ্ছে।
বন ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ ও ফলজ গাছের অভাব
বনাঞ্চলের খাদ্য সংকটের অন্যতম কারণ হলো পরিকল্পনাহীন বনায়ন। বন্যপ্রাণীর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ফলজ গাছের প্রয়োজন হলেও উদ্যানে এই ধরনের গাছের সংখ্যা কম। পরিবেশবিদদের মতে, অপরিকল্পিত বৃক্ষরোপণের ফলে বানর ও অন্যান্য প্রাণীদের খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
একজন পরিবেশ বিশেষজ্ঞের মতে, বানরদের স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হচ্ছে এবং তারা মানুষের ফেলে দেওয়া খাবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এর ফলে তাদের স্বাভাবিক জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় প্রশাসনের উদ্যোগ
বন বিভাগ জানিয়েছে যে, ২০২৪ অর্থবছরে সাতছড়ি সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে কিছু ফলজ গাছ রোপণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে ১০ একর জায়গায় কাঠাল, চাম কাঠাল, আম, জামসহ বিভিন্ন ফলজ গাছ লাগানো হয়েছিল, যা ধীরে ধীরে ফলন দিচ্ছে। এছাড়া, বনের মধ্যে পানীয় জলের সংকট দূর করতে একটি পুকুর খনন করা হয়েছে।
তবে এই উদ্যোগগুলো বর্তমান সংকট নিরসনে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র গাছ রোপণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।
সম্ভাব্য সমাধান ও ভবিষ্যৎ করণীয়
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বন্যপ্রাণীদের টিকে থাকার জন্য একটি টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- বনের অভ্যন্তরে ফলজ গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা, যা দ্রুত ফলন দিতে পারে এবং বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারে।
- পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করা, যাতে তারা বানরদের খাবার না দেন এবং তাদের স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসে ব্যাঘাত না ঘটে।
- বন্যপ্রাণীদের জন্য বিকল্প পানির উৎস তৈরি করা, যাতে শুষ্ক মৌসুমেও পানির অভাব না হয়।
- বানরদের লোকালয়ে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে বনাঞ্চলের পরিবেশগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা, যাতে তারা স্বাভাবিকভাবে বনে অবস্থান করতে পারে।
- রাস্তার পাশে সতর্কতা চিহ্ন ও নিরাপদ পারাপারের ব্যবস্থা করা, যাতে বন্যপ্রাণীদের দুর্ঘটনা হ্রাস পায়।
উপসংহার
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বানরদের লোকালয়ে চলে আসা শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র সমস্যা নয়, এটি বৃহত্তর পরিবেশগত সংকটের প্রতিফলন। বন ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট কারণগুলোর সম্মিলিত প্রভাবের ফলে বন্যপ্রাণীরা তাদের স্বাভাবিক আবাসস্থল থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
এই সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন, যাতে বন্যপ্রাণী ও বন উভয়ই টিকে থাকতে পারে। শুধুমাত্র গাছ লাগানো কিংবা পানির উৎস তৈরি করাই যথেষ্ট নয়, বরং বন ব্যবস্থাপনায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করতে হবে, যা প্রকৃতি ও প্রাণীদের জন্য উপযুক্ত হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে, ভবিষ্যতে আরও বড় পরিবেশগত সমস্যার মুখোমুখি হতে হতে পারে।